বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার আঘাত কর্মসংস্থানে

যোগ হয়েছে ফিরে আসা ১০ লাখ প্রবাসীর বাড়তি চাপ, আত্মকর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার, চাঙ্গা হচ্ছে এসএমই খাত, দারিদ্র্যসীমার নিচে ২১ শতাংশ মানুষ

মানিক মুনতাসির

করোনার আঘাত কর্মসংস্থানে

মো. আলমগীর ২৫ বছর ধরে জামদানি শাড়ি বোনেন। স্ত্রী মাফুজা আক্তার কাজের সঙ্গী। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীতে গভীর সংকট তাদের জীবনে। কাজ নেই। সর্বশেষ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে তাঁতের সামগ্রী। সংসার চালাতে আলমগীর এখন চা বিক্রি করছেন। তিনি আশাবাদী কয়েকদিন পরে আবার নিজের পেশায় ফিরে যাবেন। গতকাল নারায়ণগঞ্জের জামদানি শিল্প নগরী রূপগঞ্জ থেকে ছবি তুলেছেন জয়ীতা রায়

মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দীর্ঘায়িতই হচ্ছে, যার আঘাতে দেশের সর্বস্তরে নেমে এসেছে অচলাবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা খোলা হলেও হুমকির মুখে পড়েছে কর্মবাজার। প্রতিদিনই কাজ হারাচ্ছেন মানুষ। এতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বেকার সমস্যার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন বেকারের মিছিল। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় বেকারের বোঝার সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশে ফিরে আসা প্রায় ১০ লাখ প্রবাসীর চাপ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে জীবন বাঁচাতে দেশে ফিরে আসাদের বেশির ভাগই এখন বিপাকে পড়েছেন। শিগগিরই পুরনো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারছেন না। আবার নিজ দেশেও কাজের তেমন কোনো সুযোগ নেই। ফলে অন্য সব সমস্যা ছাপিয়ে বেকার সমস্যা এখন সবচেয়ে সংকট হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপের তথ্যমতে, গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) অন্তত ১৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বেকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। আর নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন ২১ শতাংশ মানুষ। ডিসেম্বরের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আইএলওর তথ্যমতে, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৭০ শতাংশ কর্মীই কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও মোটেই সুখকর নয়। নতুন করে কতসংখ্যক মানুষ বেকার হবেন এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনই বলা যাবে না। তবে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশও উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের অত্যন্ত ২ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবেন। আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বেকারত্বের সঙ্গে বাড়বে সামাজিক সংকটও। এরই মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। আর জীবন-জীবিকার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে লক্ষাধিক পরিবার ঢাকা ছেড়েছে বলে জানা গেছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে কভিড-১৯ চলছে। এটার যে অনিশ্চয়তা তা সবার কাছে একই রকম। ফলে দুর্ভোগ কবে কেটে যাবে তা বলা যাবে না। ফলে আমরা আসলে কেউই জানি না এর প্রভাব কবে শেষ হবে। এর ফলে গত ২৯ বছর পর দেশে নতুন কিছু মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হচ্ছে। এ ছাড়া আগের বেকার সমস্যা তো আছেই। টিকতে না পেরে বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। আবার যারা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন, তারাও আর ফিরে যেতে পারছেন না। আবার এই পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করেছে ৪০টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি। এখান থেকে দুই ধরনের পথ নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমটা হচ্ছে আপৎকালীন কাজ। সেটি হলো মানুষকে নগদ সহায়তা দিতে হবে, যেন তারা খাবারের কষ্টে না পড়ে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান ধরে রাখতে হবে। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাদের সহায়তা দিতে হবে। একইভাবে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ দুটোকে উদ্ধারের জন্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা- যেমন শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা মানুষকে দিতে হবে অধিকারভিত্তিক। খয়রাতিভিত্তিক নয়।’ এ জন্য পুনর্বাসন, পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কভিড-১৯ প্রভাবটা বহুমাত্রিক। এর অনিশ্চয়তা কবে কাটবে কেউই জানি না। ফলে এর একটা বড় প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর। ইতিমধ্যে ১৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বেকার হয়ে গেছেন। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে হয়তো আরও অনেক মানুষই কাজ হারিয়ে ফেলবে। এর জন্য আসলে কার্যকর পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোকে সচল করতে হবে। মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। অন্যথায় সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, যারা ইতিমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর যারা ফেরত যেতে পারছেন না, তাদের স্থানীয়ভাবে কাজের ব্যবস্থা করা হবে। এ ক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থানকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীসহ স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ইতিমধ্যে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ও করা হয়েছে, যা কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আড়াই শ কোটি টাকা করে বিতরণ করবে। এ অর্থ বিদেশ থেকে ফিরে আসা যুবক ও অন্য বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। এর সুদের হার হবে খুব অল্প। এর মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব সমস্যা অনেকটাই কাটবে বলে মনে করে সরকার। এ কারণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে এসএমই ও এমএসএমই খাতকে চাঙ্গা করা হচ্ছে। চাকরি খোঁজার পরিবর্তে উদ্যোক্তা তৈরিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ দুটি খাতের ব্যাংকিংসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত করোনা মোকাবিলার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৩০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই অর্থ ইতিমধ্যে ছাড় করা শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের অনেকেই নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সংস্থাটি ইতিমধ্যে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই এডিবির ওই তহবিলও পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণসুবিধা অনুমোদন করেছে।

করোনা-পরবর্তী বিশ্বে দুই ধরনের সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এর মধ্যে একটি খাদ্য সংকট, অন্যটি কর্মসংস্থান। দেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই চলছে ছাঁটাই আতঙ্ক। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শিল্পমালিকরাও খরচ কমানোর জন্য কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে এটা শুরুতে বোঝা যায়নি। এখন তো শুধু লম্বায়িতই নয়, আসলে কবে নাগাদ এটা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তারও তো কোনো সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। অর্থনীতিতেও অচলাবস্থা। ফলে কর্মসংস্থানে এর একটা বড় প্রভাব তো পড়বে, যা এখনই পড়তে শুরু করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর