বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

সম্পর্কে নতুন ‘ব্রেকথ্রো’

♦ প্রধানমন্ত্রী মোদি মনে করেন শক্তিশালী সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে হবে : শ্রিংলা ♦ সম্পর্ক উন্নততরই আছে, আমরা একমত : মাসুদ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সম্পর্কে নতুন ‘ব্রেকথ্রো’

ঢাকায় সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার হাতে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন

করোনাভাইরাসের মহামারীতে বৈশ্বিক যোগাযোগ বন্ধ থাকার মধ্যেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন ‘ব্রেকথ্রো’ এসেছে বলে মনে করছেন প্রতিবেশী দুই দেশ। গতকাল ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ অভিমত উঠে এসেছে। ঢাকা সফর যাওয়ার আগে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা জানিয়েছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েই নরেন্দ্র মোদি তাকে ঢাকা পাঠিয়েছেন। সেই সঙ্গে ভারতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির যে মহাযজ্ঞ চলছে তাতে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে বলেও স্পষ্ট জানিয়ে গেছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন, দুই দেশের সম্পর্ক যে উন্নততরই আছে, সে বিষয়ে আমরা একমত। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা সফরে আসা ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা গতকাল বিকালে বিশেষ বিমানে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে দুপুরে হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকদের বলেন, খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমার সফর অত্যন্ত সন্তোষজনক। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছেন, কভিড পরিস্থিতির কারণে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। আমি যে কারণে এসেছি তা হলো, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  মনে করেছেন কভিড সময়ে তেমন যোগাযোগ হচ্ছে না। তবে অবশ্যই সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে হবে। এ কারণে শুরুতেই আমি এলাম। তিনি বলেন, কভিড মোকাবিলায় আমরা (ভারত) কী করছি তা আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছি। কারণ বাংলাদেশের মতো আমাদেরও বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। কভিড মোকাবিলায় আমাদের সবাইকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মৃত্যুহার কম, সুস্থতার হার উচ্চ। শ্রিংলা বলেন, ভারত ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে। আসলে আমরা অ্যাডভান্সড পর্যায়ে আছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমরা অনেক বড় পরিসরে ভ্যাকসিন উৎপাদনে যাচ্ছি। বিশ্বের মোট ভ্যাকসিনের ৫০%ই উৎপাদন করেন ভারত। যখন ভ্যাকসিন তৈরি হবে, তখন বিনা দ্বিধায় বলা যায় আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, অংশীদার ও প্রতিবেশী দেশগুলো অগ্রাধিকার পাবে। নরেন্দ্র মোদির বিশেষ বার্তা নিয়ে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশে এসেছে। সেই বিশেষ বার্তাটা কী জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, কভিডের মধ্যে যেহেতু কোনো দেশেরই সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। সেটার একটা ব্রেকথ্রো হিসেবেই দুই দেশের পক্ষ থেকে দেখা হচ্ছে। স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের পরামর্শক্রমেই হর্ষবর্ধন শ্রিংলা কভিডের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন। এটাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশেষ বার্তা যে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এতটাই বিশেষ গুরুত্ব দেন যে এই পরিস্থিতিতেও তারা বড় লেভেলের প্রতিনিধি বাংলাদেশে পাঠালেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব আমাকেও নয়াদিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠকের আগেই হয়তো নয়াদিল্লি যাব। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বা সোশ্যাল মিডিয়াতে যেসমস্ত খবর দেখতে পেয়েছি তার বিষয়ে আমরা পরষ্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আমরা একমত হয়েছি, দুই দেশের মেইনস্ট্রিম সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সম্পর্কের যে পর্যালোচনা সে অনুসারে আমরা উন্নততর একটা অবস্থানের মধ্যেই আছি। আসলে কভিডের মধ্যে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে না পারায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়েছে।

বৈঠকের এজেন্ডা ও আলোচনা সম্পর্কে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, করোনাভাইরাস পরবর্তীতে দুই দেশের সম্পর্ককে কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি। কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ভারতে যে প্রচেষ্টা চলছে, বিশেষ করে ভারতে বেশ কিছু ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে, ট্রায়ালও শুরু হয়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষত ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রস্তুত আছে বলে জানানো হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বলা হয়েছে, ভারতে যে ভ্যাকসিনগুলো উৎপাদন হচ্ছে তা শুধু ভারতের জন্য নয়। প্রথমদিকেই বাংলাদেশের জন্য ভ্যাকসিন অ্যাভেলেবল করা হবে। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোরও যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। তাই তাদের সঙ্গে কোনো কোলাবোরেশনের উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা তারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে এয়ার বাবলের প্রস্তাব ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত কয়েকটি দেশের সঙ্গে এ ধরনের এয়ার বাবল শুরু করেছে। ভারত এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে এটি শুরু করা প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাব সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুত এটা শুরু করা যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে প্রচুর সংখ্যক ক্রিটিক্যাল রোগী ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান বা চিকিৎসা করছে তারা আবার চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। আবার ভারতের যে বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে তারা আসা-যাওয়া শুরু করতে পারবে। কভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুত্থানে তাদের প্রয়োজনীয়তা আরও প্রয়োজন হতে পারে। এসব বিবেচনায় দুই দেশের মধ্যে এয়ার বাবল প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হতে পারে। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে যৌথ পরামর্শক কমিটি কাজ করে। এই কমিটির বৈঠক দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যেসব প্রকল্প চলমান আছে তার পর্যালোচনা করা যাবে। যেসব প্রকল্পে আরও গতি নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে হবে সেগুলোকে কমিটি থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া সম্ভব হবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় দুই দেশের মধ্যে যেসব ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার পর্যালোচনা করা হয়েছে। যেমন বেনাপোল-পেট্রাপোলে বাণিজ্য পুরোপুরি আটকে গিয়েছিল, অচলাবস্থা কাটাতে মালামাল পরিবহনে বিকল্প উপায়ে ট্রেনের মাধ্যমে সচল করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এখন আস্তে আস্তে স্থলপথের বাণিজ্যের পথগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কভিডের মধ্যেই দুই দেশের ট্রান্সশিপমেন্টে বন্দর থেকে ল্যান্ড রুটে ভারতের পূর্বাঞ্চলে মালামাল পরিবহনের যে ট্রায়াল রান হয়েছে তা নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় থাকা বড় প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু কাজ থেমে গিয়েছিল। এসব প্রকল্পে গতি আনার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মুজিববর্ষ উদযাপনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কডিডের কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। এখন বাকি সময়গুলো অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সে ব্যাপারেও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের সদরদফতরসহ বিভিন্ন ক্যাপিটালে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনে ভারতের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার কথা জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আগামী বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন হবে। এ উপলক্ষেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের বিষয়ে পরিকল্পনার বিষয়ও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে যেসব অস্বস্তিকর বিষয় আছে সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করার বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। চেষ্টা করা হবে আগামী মাসে বিজিবি-বিএসএফ বৈঠক আয়োজনের। বৈঠকের আগে বিএসএফের নতুন ডিজিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন যাতে করে এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু বন্ধ করা যায়। চলতি বছরের প্রথম ছয়-সাত মাসে এই মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের চেয়ে বেড়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকা বাংলাদেশি বিশেষত ২৬ জেলের আটকে থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে তাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। তাবলিগ জামাতে যাওয়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয় নিয়েও ভারতের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব জানান, ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশ তখন তাদেরকে সমর্থন দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন পাস করার বিষয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু কিছু কিছু স্থায়ী সদস্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আমরা ভারতের কাছ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহায়তা চেয়েছি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রিংলার সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব স্মিতা পন্থ, ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুম বিন মোমেনের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর