শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

সেদিনের ভয়াবহতায় এখনো ঘুম ভেঙে যায়

আহতদের আর্তনাদ

রফিকুল ইসলাম রনি

শরীরে দেড় হাজার স্পি­ন্টার। জোড়াতালির হাত-পা। মরেও বেঁচে আছি। সেদিনের নারকীয় ঘটনা মনে পড়লে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে এখনো। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় এখনই ঘটল বীভৎস সেই ঘটনা। কথাগুলো বলছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, সাবেক সংরক্ষিত আসনের এমপি নাসিমা ফেরদৌস। আজ থেকে ১৫ বছর আগে যাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলায় মৃত ভেবে ঘটনাস্থলে লাশের ট্রাকে তোলা হয়েছিল। সারি সারি লাশের সঙ্গে রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেলের করিডরেও। কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলে চিৎকার করতেই চিকিৎসা করা হয় তাকে। তিনি সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা করছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর কাছে।

শুধু নাসিমাই নন, এমন রক্তাক্ত একুশে আগস্টের নারকীয় ঘটনা এখনো দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে। ঘটনার এত বছর পরও মাঝে-মধ্যে গভীর রাতে তাদের ঘুম ভেঙে যায় গ্রেনেডের আওয়াজ, লাশ, আর্তচিৎকার আর সহকর্মীদের বিলাপের স্মৃতির তাড়নায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি এবং আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা। প্রাণ হারান সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সেই সময়ের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ দলের তৎকালীন ২৪ নেতা-কর্মী। আহত হন পাঁচ শতাধিক, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন কিংবা কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। মৃত্যুর এত কাছাকাছি গিয়ে  আবার ফিরে আসায় হয়তো তারা নতুন জীবন পেয়েছেন কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদের বহন করে যেতে হবে সেই বিভীষিকার স্মৃতি। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরদিন পত্রিকায় মৃতদের ছবির সঙ্গে ছাপা হয়েছিল সাভারের মাহবুবা আকতারের ছবি। তিনি ছিলেন মৃতদের তালিকায়। সেই দিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে মাহবুবা বলেন, ‘শরীরে দেড় হাজার স্পিøন্টার। রাতে এক ঘণ্টা ঘুম হয়। বাকি সময়টা এপাশ-ওপাশ করেই কাটাই। চোখ বুজলেই এখনো শুনতে পাই সেই ভয়াবহ নারকীয় গ্রেনেডের শব্দ। রাত ২টা বাজলেই ঘুম ভেঙে যায়।’ তিনি আরও জানান, শরীরে যে ১৮০০ স্পিøন্টার তার মধ্যে মাথার দুটি স্পিøন্টার খুব যন্ত্রণা দেয়। মাঝে-মধ্যেই তিনি পাগলের মতো হয়ে যান। তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়।’ এই দুই নারী নেত্রীই তাদের জীবদ্দশায় গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিদের রায় কার্যকর দেখে যেতে চান। আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তির শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে পল্লবী থেকে ৮৪টি ট্রাকে লোকজন নিয়ে উপস্থিত হন পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হন তিনি। এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য স্পিøন্টার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শরীরে অসংখ্য স্পিøন্টার বহন করছি। মাঝে-মধ্যে পা ব্যথা করে। অস্থায়ী মঞ্চ ‘বিবা-ঢাকা মেট্রো ট-১১-৩০৯৮’ এর পাশেই ছিলাম। নেত্রী মঞ্চ থেকে নামবেন এমন সময় গ্রেনেড হামলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের আহাজারি ও আর্তনাদ। আমার জীবনে এমন মৃত্যু ও রক্ত কখনো দেখিনি। ভাবতে গেলে এখনো চোখে ঘুম আসে না।

আওয়ামী লীগের শান্তির সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দায়িত্বে ছিল সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সংগঠনটির তৎকালীন সভাপতি বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গুরুতর আহত হন। তিনি বলেন, আমি তিন দিন আইসিইউতে ছিলাম, তিন দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। এরপর অস্ত্রোপচারের জন্য বিদেশে গিয়েছিলাম। একটি গ্রেনেডে প্রচুর পরিমাণে স্পিøন্টার থাকে, যখন আঘাত করে তখন বোঝা যায় না কিন্তু যখন রক্ত ঝরতে থাকে, তখন বোঝা যায় তার বিষক্রিয়া। এখনো শরীরে অনেক স্পিøন্টার। তিনি বলেন, এই ধরনের নারকীয় হামলা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে সেদিন গুরুতর আহত হন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। তাকে প্রথমে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়নি। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় সিকদার মেডিকেলে। তিনি জানালেন এখনো শরীরে ২৪টি স্পিøন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। অমাবস্যা, পূর্ণিমার রাতে কিংবা আকাশে মেঘ জমলে প্রচ- ব্যথা করে। সেদিনের স্মৃতি কোনো দিন ভুলবার নয়। গ্রেনেড হামলার শিকার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের খাদ্যনালির ৯ ইঞ্চি কেটে ফেলা হয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতিচারণা করে এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘মানুষের দোয়ায় এবং আল্লাহর রহমতে এখন ভালো আছি। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা মনে পড়লে এখনো দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।’ তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। ’৭৫-র ঘাতকের প্রতিনিধিরাই একুশে আগস্ট ঘটিয়েছিল। ‘এই হামলা যে শুধু আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য করা হয় তা নয়, ১৫ আগস্টের কুশীলবরা এই হামলার মাধ্যমে দেশকে গণতন্ত্রশূন্য করতে চেয়েছিল।’ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জোবায়দুল হক রাসেল গ্রেনেড হামলায় আহত হন। তিনি বলেন, শত শত মানুষ আহত পড়ে আছে, ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার। সবাই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছেন। অথচ বিএনপি-জামায়াতের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে। সেদিনের দৃশ্য ভাবতে গেলে গা ছমছম করে। কীভাবে যে মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে এলাম। আজও আমার শরীরে অনেক গ্রেনেড কণা। সান্ত্বনা একটাই, জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত নারী নেত্রী আইভি রহমানকে উদ্ধারকারী লাল জামা পরিহিত ব্যক্তি আবুল কাশেম। তৎকালীন ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। আইভি রহমানকে উদ্ধারের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) ভাষণ শেষ করলেন। এমন সময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। দিশাহারা মানুষের দৌড়াদৌড়ির ভিড়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমাকে ডিঙিয়ে হাজার হাজার মানুষ একের পর এক ছুটে যাচ্ছে। আমি ওঠার সুযোগ পাচ্ছি না। জয় মার্কেটের কলাপসিবল গেটের কাছে পড়ে আছি। চোখ তুলে দেখি সভানেত্রীকে ঘেরাও দিয়ে দলের নেত্রীরা গাড়িতে তুলছেন। শরীরে ব্যথা। কোনোমতে নিজেকে টেনে তুললাম। সাংবাদিক শাহেদ (সমকালের নগর সম্পাদক শাহেদ চৌধুরী) ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘নেত্রীর কী অবস্থা’? তিনি বলেন, ‘নেত্রী আছেন।’ নেত্রী চলে যাওয়ার পরে পার্টি অফিসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সুরঞ্জিত দা, হানিফ ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় বের হচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর সাহারা খাতুনকে বের হতে দেখি। তাকে স্টেডিয়ামের কর্নারে তার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম। এসে দেখলাম আইভি চাচি (আইভি রহমান) ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রাস্তায় শুয়ে আছেন। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে পুলিশ। অনেক আহত এবং মৃতদেহে পুলিশ লাথি মারছে। উনাকে (আইভি রহমান) তুললাম। আমি বোঝার চেষ্টা করছি উনি বেঁচে আছেন কি-না। তাকে তো দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কিন্তু আশপাশে কোনো গাড়ি নেই, রিকশা নেই, ভ্যান নেই, কিছু নেই। তাকে তুলে দেব কোথায়? ধরেই রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে লিটন আসলেন। লিটন আইভি চাচির ফ্যামিলি মেম্বার। দুজনে তাকে ধরে রাখলাম। এ সময় নেত্রীর গাড়ির ড্রাইভার আলী হোসেন (শহীদ নূর হোসেনের ভাই) একটা গাড়ি নিয়ে আসলেন। তাকে বললাম, ভাই, আইভি চাচি পড়ে আছেন। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। ধরাধরি করে আইভি চাচিকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দিলাম। সারা মাঠে বিচ্ছিন্ন হাত, পা। রক্তমাখা জুতা, স্যান্ডেল, শার্ট আর পতাকা। যেন মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না বেঁচে আছি। সে যাত্রায় চিকিৎসায় সেরে উঠলাম। কিন্তু বীভৎস সেই স্মৃতি এখনো মনে চেপে আছে। সেই স্মৃতি স্বপ্নে এসে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেয়। সেই দিনের বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিক কাইয়ুম আহমেদ বলেন, সেই ভয়ঙ্কর শব্দ এখনো কানে বাজে। ভয়ে থর থর করে কাঁপি। ঘুমও আসে না; যদিওবা আসে স্বপ্নের মধ্যে দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে ফিরি, আঁতকে উঠি। এই বুঝি আবার জনতার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যাই। এখনো গ্রেনেড হামলার যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন নেতা লিটন মোল্লা। তিনি বলেন, নেত্রীর বক্তব্য শেষে স্লোগান দেই ‘নেত্রী তুমি এগিয়ে চলো-আমরা আছি তোমার সাথে’। এরপর নিজেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আবিষ্কার করি। শরীরে অসংখ্য স্পিøন্টার, অসহ্য যন্ত্রণা দেয়। সংসারেও চরম অভাব অনটন চলছে বলে জানান তিনি।

রেজিয়ার ছেলেদের দাবি : রংপুর প্রতিবেদক নজরুল মৃধা জানান, মায়ের হত্যাকারীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিয়া বেগমের দুই ছেলে হারুন উর রশিদ ও প্রতিবন্ধী নুরুন নবী। গতকাল রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া গঙ্গানারায়ণ গ্রামে তারা আবেগতাড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, মৃত্যুর ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও মায়ের ছবি নিয়ে কাঁদি। আমার নানারও শেষ ইচ্ছা ছিল তার মেয়ের হত্যার বিচার দেখে যেতে, কিন্তু তার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা আরও জানান, তাদের মা রেজিয়া বেগম ঢাকার আগারগাঁওয়ে ভারতীয় দূতাবাসে ভিসায় ছবি লাগানোর কাজ করতেন। বাস করতেন হাজারীবাগ এলাকায়। রেজিয়া হাজারীবাগ মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত হতেন। একুশে আগস্ট ঘটনাস্থলে রেজিয়ার মৃত্যু হয়। ২২ আগস্ট রেজিয়ার পিতা-মাতা মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ঢাকায় গিয়ে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন, পরে তাকে ঢাকা আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর