সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা
আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রক্রিয়ায় আমাদের দলের অভ্যন্তরে নানা খেলা শুরু হয়েছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রক্রিয়ায় আমাদের দলের অভ্যন্তরে নানা খেলা শুরু হয়েছিল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন, সে সময় প্রয়োজন ছিল সবার একাত্ম হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানো এবং সহযোগিতা করা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তাঁকে হত্যা করা হয়। আর এ প্রক্রিয়াটা শুরু করার জন্য দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের খেলা শুরু হয়।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গতকাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনের এ সভায় গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পেছনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাত ছিল। বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ডে জিয়াউর রহমান আসল খলনায়ক ছিলেন। তিনি বলেন, ২১ বছর ধরে জাতির পিতার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। এ দেশের মানুষের হƒদয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই কয়েকটা খুনি, বেইমান বা মোনাফেক ছাড়া অগণিত মানুষ জাতির পিতার জন্য কাঁদে। ১৫ আগস্টে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট শুধু একটা হত্যাকান্ড ঘটানো হয়নি। এর একটা লক্ষ্য ছিল, যে আদর্শ নিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে আদর্শ ও লক্ষ্যকে ধ্বংস করা। বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিল, এটা তারা মানতে পারেনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের পাশে ছিল, তারাও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিজয়কে মানতে পারেনি। কাজেই ষড়যন্ত্র চলছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দেশের ভিতরের অনেকেই বোধহয় তা বুঝতে পারেনি। জাতির পিতাকে হত্যা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বলেন, এ ছাড়া কিছু লোক যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দালালি করেছিল এবং পাশাপাশি কিছু লোক যারা জেনে হোক বা না জেনে হোক নানাভাবে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। সমালোচনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাদের লেখনী ও কার্যকলাপ ছিল পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে অপবাদ ছড়ানো। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল জাতির পিতার জনপ্রিয়তা, সারা দেশের মানুষের কাছে তাঁর যে গ্রহণযোগ্যতা তা নষ্ট করা। সেটা যখন তারা পারেনি তখন হত্যার পথ বেছে নেয়। যে কথাটা আমরা পাই বিবিসির কাছে দেওয়া কর্নেল ফারুক ও রশীদের ইন্টারভিউয়ে। তারা এ কথাটাই বলেছিল, দীর্ঘদিন ধরে তারা চেষ্টা করছিল বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে সরাতে। কিন্তু জনগণের মন থেকে মুছতে পারেনি। তাই তারা এ ধরনের হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, কর্নেল ফারুক-রশীদরাই এটা বলেছে যে জিয়া সব সময় তাদের সঙ্গে ছিল এবং মোশতাক অবৈধভাবে যখন ক্ষমতা দখল করল, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিল; তখনো খুনিদের সঙ্গে এবং মোশতাকের পাশে ছিল। এ কারণেই জিয়াউর রহমানকে তখন সেনাপ্রধান করা হয়। এর মাধ্যমে মোশতাক এটাই প্রমাণ করে দিল, তারা একসঙ্গে চক্রান্তে সম্পৃক্ত ছিল। তিনি বলেন, কিন্তু মোশতাক বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আমরা ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, দেখি সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করেছিল মীরজাফর। ব্রিটিশ বেনিয়ার দল তাকে ব্যবহার করেছিল। সেও কিন্তু তিন মাস ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। দুই মাসের বেশি কিছু সময় পর তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ঠিক মোশতাকও তাই। যাদের প্ররোচনায় সে এ বেইমানি বা মোনাফেকিটা করেছিল এবং জাতির পিতার হত্যাকান্ডে মদদ দিয়েছিল তারা কিন্তু তাকে ক্ষমতায় রাখেনি। ক্ষমতায় চলে আসে আসল খলনায়ক জিয়াউর রহমান। মোশতাকের পতনের পর জিয়াউর রহমান হয়ে গেল একাধারে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি। এ দুই পদ নিয়েই সে বিরাজমান ছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী এবং যারা পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিল তাদের ফিরিয়ে এনে মন্ত্রী বানাল। যারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে, পাকিস্তানিদের কাছে আমাদের মেয়েদের তুলে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে তারা হলো মন্ত্রী! এ সময় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অনেকে কেন জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর ‘কোনো দিন পাননি’ বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে, তারা কি এটা পারে? আর এখনো দেখা যায় যে কিছু কিছু লোক, এরা সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে। এ দেশে যত রক্তপাত, যত হত্যাকান্ড, যা কিছু- সবই তো সেই থেকে শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গভীর চক্রান্ত কাজ করছিল। যেন আমাদের বিজয়টা ধরে রাখতে না পারি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয়ের যে পতাকা তা যেন না থাকে এটাই ছিল তাদের অপচেষ্টা। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার নাম তো মুছেই ফেলা হয়েছিল! এ নাম নেওয়া যাবে না। ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো যাবে না। স্বাধীনতার ঘোষক সৃষ্টি হলো। ইতিহাস বিকৃতির চরম একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সত্যকে কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারে না, আজ তা প্রমাণিত। ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্রবৃদ্ধি কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু থেমে যায়। তবু আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে যতটুকু পারি মানুষের জন্য কাজ করে যাব। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। কোনো মানুষ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে, কোনো মানুষ যেন গৃহহারা না থাকে, কোনো মানুষ যেন রোগে কষ্ট না পায় এবং প্রতিটি মানুষ যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়। সবার জীবন যেন সুন্দর হয়। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া যেমন জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে জড়িত, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত, একের পর এক ক্যু করে সেনা সদস্যদের হত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ঠিক একই ঘটনা ঘটিয়েছে। জিয়াউর রহমান যেমন সেই আবদুল আলিম থেকে শুরু করে মাওলানা মান্নান থেকে শুরু করে শাহ আজিজ থেকে শুরু করে, তাদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপদেষ্টা বানিয়েছিল। একইভাবে আমরা দেখেছি খালেদা জিয়া সেই নিজামী থেকে শুরু করে যারা যারা একেবারে সরাসরি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের মন্ত্রী বানিয়েছিল। খুনি রশীদ এবং হুদা, তাদের ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ভোট চুরি করে পার্লামেন্টে এনে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসায়। খালেদা জিয়া কেন এটা করেছিল? এর জবাব কি বিএনপি দিতে পারবে? শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তারা বারবার আমার ওপর আস্থা রেখেছে। আমাদের ভোট দিয়েছে। তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে আমাদের অনেক কর্মসূচি ছিল, কিন্তু আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা কিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে করেছি। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের লক্ষ্য- বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি মানুষকে আমরা মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করে দেব।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবু নাসের চৌধুরী। এরপর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। অনুষ্ঠানে কবি মহাদেব সাহার কবিতা আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর