সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

অর্থ সংকট কাটাতে পথ খুঁজছে সরকার

দিনে ২৫৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে সরকার

মানিক মুনতাসির

অর্থ সংকট কাটাতে পথ খুঁজছে সরকার

করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে প্রায় ৪৫ বছর পর প্রথমবারের মতো রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থাৎ রাজস্ব ঘাটতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ফলে নিয়মিত এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন সচল রাখতেও সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। যদিও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন সব প্রকল্পে বরাদ্দ থাকা অর্থ কেটেও আনা হয়েছে। এরপরও সরকারের অর্থ সংকট কাটছে না। আবার সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও বেড়েছে। কিন্তু করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকারের খরচ যেমন বেড়েছে অন্যদিকে আয়ও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে এক প্রকার ব্যাংক থেকে ধার করেই চলছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সংকট মেটাতে সরকার প্রতিদিন ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ২৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। যা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে করোনার কারণে বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণের অর্থছাড়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে উচ্চতর রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টারত রপ্তানি খাতের কারণে সরকারের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য) পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু সরকারের দৈনন্দিন খরচ আর উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পথ খুঁজছে সরকার। এ জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়মিত রাজস্ব আদায় কার্যক্রমের পাশাপাশি বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম নেওয়া যায় কিনা-সে বিষয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অর্থ বিভাগ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে নতুন করদাতা ধরতে। বিশেষ করে কর ফাঁকি কীভাবে বন্ধ করা যায় সে ব্যাপারেও দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। এদিকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন আইনে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের জন্য ইলেকট্রনিকস ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে বসানোর কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি এনবিআর। তবে দোকানে দোকানে ইএফডি বসানোর কাজ চলতি মাসের ২৫ তারিখ (কাল) উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ২৫ আগস্ট ১০০টি ইএফডি মেশিন বসানো হচ্ছে। সেগুলোর অপারেশন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও মেশিন বসানো হবে। এতে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আদায়ে গড়ে ১৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হলেও এবার উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেছে। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৯-২০) রাজস্ব আদায় কমে গেছে পূর্বের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে কমিয়ে আনা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ঘাটতি প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর মূল বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবার ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ওই সময় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আয়ে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর প্রায় ৪৫ বছর পর করোনাভাইরাসের প্রভাবে এবার রাজস্ব আয়ে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে বছর শেষে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিই হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও ভালো নয়। যদিও হিসাব পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্র্তারা।  এদিকে অর্থ সংকট মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে ব্যাপক হারে। অর্থবছরের প্রথম ৪৩ দিনেই সরকার ঋণ নিয়েছে ১০,৯৫৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২৫৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিচ্ছে সরকার। যা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য এই কদিনে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণও শোধ করেছে ২,৫৩৬ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এর মধ্যে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকাই ব্যাংক থেকে নেবে সরকার। আর অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার জোগান ঠিক রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে প্রণোদনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতির কারণেই ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে সরকার। ইতিমধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় বন্ধ করেছে। একইভাবে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে অর্থ বিভাগ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে এটা তো নতুন নয়। তবে এবার নিশ্চয়ই অনেক বেশি পরিমাণে কমেছে। এমন একটা ধাক্কা আসবে তা তো আগেই বোঝা গেছে। কেননা করোনার কারণে সারা বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা বিরাজ করছে। এই সংকট সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। ফলে আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়েছে। এতে করে সরকারেরও আয় কমেছে। সরকার যে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে তার আগে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে সরকারের অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। যা এই সংকটকালে কাজে লাগবে বলে তিনি মনে করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর