বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

চলে গেলেন সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলে গেলেন সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) বীরউত্তম আর নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবিচের বেথেসডা সাউথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল) তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর আট মাস।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি লাবলু আনসার জানান, জেনারেল দত্ত তিন দিন আগে মেয়ের বাসায় পড়ে গিয়েছিলেন। পায়ে অস্ত্রোপচার করতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আর সুস্থ হননি।

সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।

বেশ কয়েক বছর ধরেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিউইয়র্কে বাস করে আসছিলেন সি আর দত্ত। বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত ও ছেলে ডা. রাজা দত্ত সেখানেই থাকেন। গত বিজয় দিবসে নিউইয়র্কে রাজা দত্তের বাসায় যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আয়োজনে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের স্মৃতিচারণা করেন তিনি। সে সময় তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কোনো অনুষ্ঠানে সেটাই ছিল তাঁর সবশেষ বক্তৃতা।

সি আর দত্ত গত বছরের শেষ দিক থেকে ফ্লোরিডায় ছোট মেয়ে কবিতা দাশগুপ্ত হ্যাপির বাসায় চলে যান। মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিউইয়র্কে না ফিরে তিনি ফ্লোরিডাতেই থেকে যান। ছোট জামাতা প্রদীপ দাশগুপ্ত জানান, গত বৃহস্পতিবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙে যায় তাঁর শ্বশুরের। হাসপাতালে নেওয়ার পর পায়ে অস্ত্রোপচারও করা হয়। অস্ত্রোপচারের সময় তাঁকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে হয়েছিল। তাঁর ছিল হাঁপানি। সার্জারির পর শ্বাসকষ্ট খুবই বেড়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে কিডনিও। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞা ফেরানো সম্ভব হলেও পরে অবস্থার আরও অবনতি হয়। সোমবার দুপুরেই চিকিৎসকরা তাঁকে ফেরানোর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চান তারা। তাঁর আরেক মেয়ে কানাডা থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন বাবার লাশ গ্রহণ করার জন্য। ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের রাজধানী শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন সি আর দত্ত। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার। প্রাথমিক শিক্ষা শিলংয়ে শুরু হলেও পরে তাঁর পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসে হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন সি আর দত্ত। ’৫১ সালে যোগ দেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ’৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত। সে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করে।

সি আর দত্ত ’৭১-এ ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে নিজেই নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত যখন উপস্থিত, সে সময় ছুটিতে দেশেই ছিলেন সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর সি আর দত্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁকে দেওয়া হয় ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টর ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগানের আড়াল কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন। রণকৌশলের অংশ হিসেবে পরে রশীদপুর থেকে ক্যাম্প সরিয়ে নেন মৌলভীবাজারে।

ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য দেশ স্বাধীনের পর তাঁকে ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তার দায়িত্ব দেওয়া হয় সি আর দত্তকে। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক তিনি। পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান সি আর দত্ত। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন সি আর দত্ত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। সি আর দত্তের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু প্রমুখ। আরও শোক জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ ৭১। যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহমেদ ও সেক্রেটারি মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার ও সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি অধ্যাপক নব্যেন্দু বিকাশ দত্ত শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সদস্যসচিব অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শফিকুল বাহার মজুমদার টিপু। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন এম এ আউয়াল শোক প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ খবর