মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও গৌতম লাহিড়ী, নয়াদিল্লি

চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু

চলে গেলেন বাংলাদেশের বন্ধু ও নড়াইলের জামাই, ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখার্জি। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ৮৪ বছর বয়সে দিল্লির সেনা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রণব মুখার্জির পুত্র সাবেক সংসদ সদস্য কংগ্রেস নেতা অভিজিৎ প্রথম তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানান। তাঁকে ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’ বলা হতো।

ভারতের প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী     শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত তৈরিতে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রণব মুখার্জির মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল প্রণব মুখার্জির মৃত্যুর খবর জেনে শোকে আপ্লুত ও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। এক শোকবার্তায় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও নিজের বহু স্মৃতি স্মরণ করেন তিনি।

শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালে প্রণব মুখার্জি আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। ওই দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। যে কোনো প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আরও বলেন, দেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জি সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যে কোনো সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারাল একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারাল একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

তিন সপ্তাহ সেনা হাসপাতালে প্রণব মুখার্জি চিকিৎসাধীন ছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রয়াণে ভারত সরকার সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে। মরদেহ হাসপাতাল থেকে দিল্লিতে তাঁর রাজাজি মার্গের বাসভবনে নেওয়া হয়। ৯ আগস্ট বাড়িতে পড়ে গিয়ে তিনি আঘাত পান।

প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিৎ টুইটে বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করছি, সেনা হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রয়াস ও জনতার প্রার্থনা এবং দোয়া সত্ত্বেও তাঁকে বাঁচানো গেল না। আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট বার্তায় বলেন, ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে দেশ শোকাহত। ভারতের প্রগতিতে তাঁর একক ভূমিকা রয়েছে। তিনি সব স্তরের রাজনৈতিক দলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি এও বলেন, ‘আমি ২০১৪ সালে দিল্লিতে নবাগত। তখন তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলেছি। সেটা আমার পাথেয় ছিল। তাঁর সহযোগিতা আশীর্বাদ আমি কখনোই ভুলতে পারব না।’

প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। গতকাল নিজের ফেসবুকে সাবেক প্রেসিডেন্টের একটি ছবি পোস্ট করে তার নিচে মমতা লেখেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি, সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে আমি গভীরভাবে শোকাহত। একটি যুগের অবসান হলো আজ। রাজনৈতিক জগতে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হলো। তাঁর জীবনাদর্শ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। তাঁর পরিবার-পরিজন, অগণিত অনুগামী-শুভানুধ্যায়ীকে জানাই গভীর সমবেদনা।’

গতকাল সকালে সেনা হাসপাতাল জানায়, প্রণব মুখার্জির শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তার পর থেকে তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে সেপটিক হয়। তিনি ভেন্টিলেটরে ছিলেন। প্রণব মুখার্জির দুই ছেলে অভিজিৎ ও ইন্দ্রনীল। দ্বিতীয় ছেলে তিনি দত্তক নেন। কন্যা শর্মিষ্ঠা জাতীয় কংগ্রেস নেত্রী ও মুখপাত্র।

২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত দেশের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন প্রণব মুখার্জি। গত বছর আগস্টে তাঁকে সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড ‘ভারতরত্ন’-এ ভূষিত করা হয়

বহু রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সমকালীন ভারতের রাজনীতিতে প্রণব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মহিরুহ। দলমত-নির্বিশেষে অজাতশত্রু ভদ্রলোক রাজনীতিকদের কাতারে সম্ভবত তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তিত্ব। দল ভুলে রং ভুলে সবাই তাঁর কাছে যেতেন রাজনৈতিক সংকট মোচনের পরামর্শ নিতে। তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান ঘটল।

১০ আগস্ট নয়াদিল্লির রাজাজি মার্গের সরকারি বাসভবনে কলঘরে পড়ে গিয়ে প্রণব মুখার্জি মাথায় আঘাত পান। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। চিকিৎসায় সাড়া দিলেও সেই থেকেই কোমায়। ক্রমেই তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ লড়াই করার পর গতকাল তিনি হার স্বীকার করেন।

প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, পরামর্শদাতা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু হয়ে পাশে ছিলেন। তাঁর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেওয়া হয়। বিয়ের সূত্রেও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন প্রণব মুখার্জি। তাঁর স্ত্রী শুভ্রা ঘোষ ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের সন্তান। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসে নড়াইলের ভদ্রবিলায় শ্বশুরালয়েও ঘুরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ‘জামাইবাবু’ প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে একান্ত আপনজন বলে জানত। ২০১৫ সালে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রার মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা জানাতে দিল্লি গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবন : প্রণব মুখার্জি ভারতের প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভারতের বিভিন্ন সরকারে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও অর্থের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিরল এ রাজনীতিকের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, দক্ষতা আর ত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা পাওয়া যাবে বিরোধী মত ও দর্শনের রাজনীতিকদের মুখ থেকেও। এটি তাঁর ভারতরত্ন খেতাব পাওয়ার যথার্থতা তুলে ধরে।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া প্রণবের বাবা কমদা কিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনও ছিল বর্ণিল। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ায় বেশ কয়েকবার কারাবরণও করতে হয় এই কংগ্রেস নেতাকে। প্রণবের মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায়।

ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর প্রণব মুখার্জি (পল্টু) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আইন বিষয়েও ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কিছুদিন কলেজের শিক্ষক ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করলেও তাঁর আগ্রহ ছিল রাজনীতিতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য বীরভূমের পল্টু ১৯৬৯ সালে সেই যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হয়ে রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন, তার পরের কয়েক দশক দল, পার্লামেন্ট আর সরকারের নানা দায়িত্ব সামলাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৮ থেকে ’৭৯ পর্যন্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। ’৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কমিটির সভাপতিও হন। একবার দল থেকে বিতাড়িতও হয়েছিলেন, ফেরেন ’৮৯ সালে।

২০০০ সালের আগস্টে ফের প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। সেবার এ পদে থাকেন এক দশক। ১৯৭৮-১৯৮৬ এবং ১৯৯৭-২০১২ দুই মেয়াদে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দুই যুগের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮২ সালে তিনি প্রথমবার অর্থমন্ত্রী হন। সে সময় ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভার এ সদস্য ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সংসদ নেতাও ছিলেন। ভারতের রিজিওনাল রুরাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট গঠনেও তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ফের ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন প্রণব। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিন বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এ কংগ্রেস নেতা ২০০৪ সাল থেকে পরের ৮ বছর লোকসভার সংসদ নেতা ছিলেন।

পাঁচবার রাজ্যসভার সদস্য ও দুবার লোকসভার সদস্য হওয়া প্রণব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ২০১২ সালের জুনে দল থেকে পদত্যাগ করেন। পরের মাসেই ভারতের ত্রয়োদশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মেয়াদ শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত এ বাঙালি রাজনীতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসেও ছিলেন।

প্রণব ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ পান। তিনি ১৯৯৭ সালে সেরা সাংসদ এবং ২০১১ সালে ভারতের সেরা প্রশাসকের পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে প্রণব ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্ন পান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়ান ডিপ্লোমেটিক একাডেমি, বেলারুশ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলিস্তিনির আল-কুদস বিশ্ববিদ্যালয়, ইসরায়েলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় ও নেপালের কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক বিভিন্ন ডিগ্রি পাওয়া প্রণব অল্প কিছু দেশ ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশই ভ্রমণ করেছেন বলে তার ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে।

১৯৮৪ সালে নিউইয়র্কভিত্তিক ‘ইউরো মানি’ জার্নালের এক জরিপে প্রণব সে সময় বিশ্বের সেরা ৫ অর্থমন্ত্রীর একজন মনোনীত হয়েছিলেন। ‘ইমার্জিং মার্কেটস’ জার্নাল তাকে ২০১০ সালে এশিয়ার সেরা অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিল। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়া এ রাজনীতিকের লেখা বইয়ের মধ্যে আছে, বিয়ন্ড সার্ভাইভাল : ইমার্জিং ডাইমেনশনস অব ইন্ডিয়ান ইকোনমি, অব দ্য ট্র্যাক, সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস, চ্যালেঞ্জেস বিফোর দ্য নেশন, থটস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস, দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস, দ্য টার্বুলেন্ট ইয়ারস ১৯৮০-১৯৯৬ ও দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২।

বাংলাদেশের বন্ধনে জড়িয়ে : মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। ভারতের অনেক রাজনীতিকের মতো তখন মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ফ্রান্সে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। একই সময়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি সফরে গিয়ে সেখানকার সরকারপ্রধান ও সংসদ সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি উপস্থাপনে ভূমিকা রাখেন তিনি।

ওই সময়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করায় ভূমিকা রাখেন তিনি।

নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’-এ একটি অধ্যায়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন প্রণব মুখার্জি।

একাত্তরে রাজ্যসভার সদস্য প্রণব লিখেছেন, ‘বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরে হত্যা করার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।

প্রণব লিখেছেন, “শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।”

২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকে (শেখ হাসিনা) ত্যাগ করছিলেন, আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক।”

প্রণব মুখার্জির স্ত্রী রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী শুভ্রা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের গ্রাম ভদ্রবিলায় কাটিয়েছিলেন। এরপর নানা বাড়িতে থেকে স্থানীয় চাঁচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। পরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভারত চলে যান। প্রণব ১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই শুভ্রা ঘোষকে বিয়ে করেন।

যারা শোক জানিয়েছেন : প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে আরও শোক জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। গতকাল এক শোকবার্তায় দলের পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তার এ বিদায় গভীর দুঃখ ও বেদনার। তার মৃত্যুতে ভারতবাসীর ন্যায় বিএনপি সমানভাবে সমব্যথী। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এম আবদুল মোমেন, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, স্থানীয় সরকার ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রমুখ।

আরও শোক জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর