মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

১৫ আগস্ট কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে

প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৫ আগস্ট কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে কার্যত : কারবালার বিয়োগান্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। জিয়াউর রহমান ছিলেন ওই হত্যাকান্ডের নেপথ্য খলনায়ক।

গত রবিবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনা সভায় অংশ নেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞ ও কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্যে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। তিনি বলেন, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ও মুসলমানদের ইমাম হজরত হোসেন (রা.)-কে কারবালায় হত্যা করা হয় আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আরও বলেন, কারবালার ঘটনায় নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ওই ঘটনায় নারী-শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে শিশু ও নারীদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও ওই রাতে মিন্টো রোডে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী ও আত্মীয়দের হত্যা করা হয়। আদর্শভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে আওয়ামী লীগ প্রধান দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নেতাদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তাদের অপকর্মের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে বিভিন্ন দিক থেকে কিছু লোক সেই দলে যোগ দেয়। দলে যোগদান করার পর তারা বিভিন্ন দুষ্কর্ম করে ও অপতৎপরতা চালায়। তখন দলকে তাদের দায়ভার নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কারণে তিনি আগেই দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করেছিলেন যাতে সামরিক স্বৈরশাসকদের প্রতিষ্ঠিত দল থেকে আসা লোকজন বা যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার সুযোগ না পায়। কারণ, তারা যদি দলে ঢুকতে পারে, তবে তারা দলের ক্ষতি করবে, এই ধরনের ঘটনায় লিপ্ত হবে এবং আমাদের ভালো নেতা-কর্মীদের খুন করবে। আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছেও। কিন্তু সত্য উদঘাটন হলে দেখা গেছে যে, হঠাৎ করেই যারা দলে ঢুকেছে, তারাই এই সব অপরাধ ও অপকর্মগুলো ঘটিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, তারা (অনুপ্রবেশকারীরা) খুব ভালো আচরণ করে যে, এতে অনেক দলীয় নেতা তাদের গ্রুপ শক্তিশালী করার জন্য তাদেরকে কাছে টেনে নেয়। এইভাবে তাদের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সুসংগঠিত এবং বিপুল সমর্থক ও জনসমর্থন রয়েছে। করোনা মহামারী সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতিই এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনা মহামারী সত্ত্বেও আমরা আমাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে পেরেছি। এর ফলে রেমিট্যান্স রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ যেন দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারে সে লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যাতে করে আমাদের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে। অর্থনীতির কর্মকান্ডের চাকা সচল রাখার জন্য আমরা জিডিপি’র ৪ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী করোনাকালে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীদেরকে ধন্যবাদ জানান। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে ঢাকা দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন। দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এ মান্নান কচি সভায় বক্তৃতা করেন। সভার শুরুতে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের অন্যান্য শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী ও ছেলের হাতে মানুষের রক্তের দাগ : গতকাল বিকালে ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী ও ছেলের হাতে মানুষের রক্তের দাগ। ইনডেমনিটি দিয়ে জিয়া যেমন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার না করে পুরস্কৃত করেছিল, ঠিক একইভাবে খালেদা জিয়াও ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ইনডেমনিটি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। এরা দেশে খুনের রাজত্ব তৈরি করেছিলেন, আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশের মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এদের হাতে মানুষের রক্তের দাগ। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যা যা করার তার সবই করে গেছে জিয়াউর রহমান।

শোকাবহ আগস্টের মাসব্যাপী কর্মসূচির সমাপনী দিনে সোমবার স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্মরণে আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, কোনো আত্মত্যাগই কখনো বৃথা যায় না। ত্যাগের মধ্যেই শান্তি, ভোগের মধ্যে নয়। একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শ না থাকলে তারা দেশকে কিছু দিতে পারে না। কী পেলাম বা পেলাম না সেটা বড় কথা নয়, মানুষের জন্য কী করে যেতে পারলাম সেটাই বড় কথা। দেশের মানুষ অবশ্যই তা একদিন মূল্যায়ন করবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারা জীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন, শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনও দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন দেশের মানুষ সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া-সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। দেশের একটি মানুষ গৃহহারা থাকবে না, প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেব। আমরা ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ নিতে যাইনি, দেশের উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছি। মিথ্যার পরিবর্তে আজ সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি যতই গলাবাজি করুক, সত্যকে অস্বীকার করবে কীভাবে? বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক-রশীদরা বিবিসিতে নিজেরাই সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছে, এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড) জিয়া তাদের সঙ্গে ছিল। আর এ কারণেই অবৈধভাবে খুনি মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। কিন্তু বেইমান-মীরজাফররা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না, মোশতাকও পারেনি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী এই জিয়া সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার-সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র-অর্থ তুলে দিয়ে বিপথে নিয়ে গেছে এবং হজের জন্য বঙ্গবন্ধুর কেনা হিযবুল বাহার জাহাজকে প্রমোদতরী বানিয়ে এই জিয়া ছাত্রদের চরিত্র ধ্বংস করেছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে যা যা করার তার সবই করে গেছে এই জিয়াউর রহমান। আর স্ত্রী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে বলেছিল আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে নাকি তার ছাত্রদলই যথেষ্ট।

বাংলাদেশে গুম-খুনের রাজনীতি জিয়াউর রহমানই শুরু করে বলে মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, অবৈধ ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে পুরো দেশকেই রক্তাক্ত করেছে এই জিয়া। ১৮-১৯টি ক্যুর ঘটনায় হাজার হাজার সেনা অফিসার-সৈনিককে হত্যা করেছে এই জিয়া। এটাই নাকি তার গণতন্ত্র! অনেক সেনা পরিবার জিয়ার আমলে লাশটুকুও ফেরত পাননি। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে শত শত মানুষকে হত্যা করে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীকেও হত্যা করে তাদের লাশ গুম করে ফেলা হয় ওই সময়ে। ভোট দিয়ে দেশ সেবার সুযোগ প্রদানের জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ দেশ সেবার সুযোগ দিয়েছিল বলেই ’৭৫ সালে দেশের যে সম্মান ভুলুণ্ঠিত হয়েছিল, সেই সম্মান আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার করেছি, যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে নেপথ্যে যারা জড়িত, ইতিহাস থেকে তাদেরও একদিন পাওয়া যাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার করে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার ইতিহাস মুছে ফেলতে, দেশকে আদর্শহীন এবং স্বাধীনতাকে অর্থহীন করতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।

দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতার পাশাপাশি বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বিশাল অবদানের কথা তুলে ধরে তাঁদের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মায়ের মতো একজন সঙ্গী পেয়েছিলেন বলেই আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) নিবেদিত প্রাণ হয়ে দেশের জন্য লড়াই-সংগ্রামসহ কাজ করে গেছেন। এটা একটা বিরল ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় আমার মা পিতা বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে সঠিক পরামর্শ দিতেন, সাহস জুগিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমানসহ ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের নিয়মিত প্রকাশনা ‘মাতৃভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।

সর্বশেষ খবর