রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুহূর্তে শেষ সবকিছু

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে নিহত ২০, দগ্ধরা শঙ্কামুক্ত নন, তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

মুহূর্তে শেষ সবকিছু

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে গতকাল স্বজনদের আহাজারি (বামে)। দুর্ঘটনার পর মসজিদের ভিতর -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা রিনা বেগম। শুক্রবার বিস্ফোরণের পর থেকেই ছেলের বিছানায় বিলাপ করে যাচ্ছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তার ছেলে রিফাতকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে রিফাতের দুই বোন। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, রিফাতের কিছু হয়নি। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ততক্ষণে এলাকার লোকজন জেনে গেছে রিফাত আর নেই। ফিরবে না কোনো দিন। রিফাতের মাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। সান্ত¡না দিতে গিয়ে ফেলছেন চোখের জল। ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস ব্যাপারী (৬৫) বিস্ফোরণে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সকাল ৯টায় তার মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজনরা। বাবার মৃত্যুর খবরে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিলেন তাঁর চার মেয়ে।

শুক্রবার এশার ফরজ নামাজ শেষে সুন্নত ও নফল পড়ার সময়টাতেই চামারবাড়ী বায়তুস সালাত জামে মসজিদের ভিতর বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। এরপর মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন একের পর এক হতভাগা মুসল্লি। সময় যত যাচ্ছে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। দগ্ধদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ইমামসহ ২০ জন মারা গেছেন। গতকাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বাকি যারা ভর্তি আছেন তাদের অবস্থাও  আশঙ্কাজনক। অধিকাংশের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। হতাহত সবাই তল্লা চামারবাড়ী বায়তুস সালাত জামে মসজিদের আশপাশের বাসিন্দা। হতাহতের স্বজনদের আহাজারিতে পুরো তল্লা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘরে ঘরে বইছে মাতম। কে কাকে সান্ত¡না দেবেন সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। স্বাধীনতার পর একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু ও আহতের ঘটনা এই প্রথম দেখলেন তল্লাবাসী। নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের তিতাস গ্যাসের লিকেজ থেকে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণ ঘটে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন আশঙ্কা করছেন মৃতের সংখ্যা বাড়ার। বাকি যারা ভর্তি আছেন তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। অধিকাংশের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় মসজিদের স্থানে স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আগুনের তা-বের চিহ্ন। পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের চামড়ার ঝিল্লি। পায়ের নখ, চুল। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কতটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের সম্মুখীন হয়েছিলেন মুসল্লিরা- বলে দিচ্ছে পুড়ে যাওয়া জায়নামাজ, ভাঙা কাচ, মসজিদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন আসবাব। তবে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও পবিত্র কোরআন আছে অক্ষত। গতকাল সকাল থেকেই তল্লার অলিগলিতে হাজারো মানুষের ভিড়। ক্লাব ও পাড়া-মহল্লায় কালো কাপড় ঝোলানো। স্বজনহারাদের আহাজারি চলছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। যাদের কেউ হতাহত হয়নি, তারাও সহ্য করতে পারছেন না একসঙ্গে এত মৃত্যু ও দগ্ধের ঘটনা। হঠাৎ প্রতিবেশীদের এমন পরিণতিতে অঝোরে কাঁদছেন তারা। আহতদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন।

এলাকার লোকজনের দাবি, গ্যাসলাইনে ত্রুটির কথা জানানো হয়েছিল তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে। এলাকাবাসীর একজন বলেন, ‘গ্যাসলাইন লিকেজেরে কথা জানানো হয়েছে অফিসকে। তারা ঠিক করতে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে।’

মৃতের মধ্যে একজনের নাম জানা যায়নি। বাকি ১৯ জন হলেন- শিশু জুয়েল (৭), মসজিদের খতিব আবদুল মালেক, মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসাইন (৪৮), রিফাত (১৮), মোস্তফা কামাল (৩৪), জুবায়েদ (১৮), সাব্বির (২১), কুদ্দুস ব্যাপারী (৭২), হুমায়ুন কবির (৭০), ইবরাহিম (৪৩), জুনায়েদ (১৭), জামাল (৪০), রাশেদ (৩০), জয়নাল (৩৮), মাইন উদ্দিন (১২), রাসেল (৩০), বাহাউদ্দিন (৬০), কাঞ্চন হাওলাদার (৪০), নয়ন (২৭)। এর মধ্যে শুক্রবার রাতেই শিশু জুয়েলের মৃত্যু হয়। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। গতকাল ভোরের দিকে মারা যান আরও ১০ জন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান আরও একজন, দুপুরের দিকে মারা যান দুজন, দুপুরের পর মারা যান দুজন, সন্ধ্যার পর আরও চারজন।

ঘটনার সময় মসজিদের অল্প দূরে ছিলেন বাপ্পিসহ বেশ কয়েকজন। তারা জানান, ৮টায় এশার আজান হয়। সোয়া আটটায় জামাত। এর মধ্যে দুবার বিদ্যুৎ গিয়ে আসে। দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ আসার পরপরই প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ‘মাগো বাবাগো’ চিৎকার শোনা যায়। মসজিদের বাইরে বৃষ্টির পানি জমে ছিল। কয়েকজনকে দেখি মসজিদ থেকে বের হয়ে সেই পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আগুন নেভানোর জন্য। তাদের শরীরের বেশির ভাগ চামড়াই নেই। পুড়ে গেছে পোশাক। এলাকাবাসী দৌড়ে এসে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ও নগরীর ম-লপাড়ায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপতালে নিয়ে যান। যে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সে মসজিদের মেসে থাকেন মিজানুর রহমান (৩৫)। তার বাড়ি পটুয়াখালী হলেও এক যুগের বেশি তিনি ওই এলাকায় ভ্যান চালান। বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিস্ফোরণের সময় সবাই নফল নামাজ পড়ছিল। হঠাৎ আগুন লেগে গেলে আমরা আটকা পড়ে যাই।’ গত রাতেও উৎকণ্ঠা নিয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে বিস্ফোরণে দগ্ধদের স্বজনদের। এর আগে শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাম জামে মসজিদে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রায় ৫০ জনের মতো দগ্ধ হন। তাদের ঢামেক হাসপাতালে স্থাপিত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।

তদন্ত কমিটি : বিস্ফোরণের রহস্য উদ্ঘাটনে এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের ডিপিডিসি পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এসব কমিটি নিজ নিজ অবস্থান থেকে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। গতকাল সকালে এসব কমিটি গঠন করা হয়।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিমউদ্দিম জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক খাদিজা তাহেরী ববিকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিহতদের লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বলে কোম্পানির নারায়ণগঞ্জ অফিসের ডিজিএম মফিজুল ইসলাম জানিয়েছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে তিতাস গ্যাসের ঢাকা অফিসের মহাব্যবস্থাপক আবদুল ওহাবকে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দেবাশিস বর্মণ, উপপরিচালক (অপারেশন্স) নুর হাসান ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন।

এসি নয়, বিস্ফোরণের উৎস গ্যাস : প্রাথমিকভাবে মসজিদে এটি বিস্ফোরণের ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করলেও মূলত তা গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন গণমাধ্যমকে বিষয়টি জানান। প্রাথমিকভাবে একই ধারণা করে শুক্রবার রাতে জানিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। তবে তিনি এও জানিয়েছেন যে, সিআইডি আলামত সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। তদন্তের পর সবকিছু পরিষ্কার করে বলা যাবে।

মাতম : আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃতদের বাড়িতে চলছে মাতম। নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের পুরনো কর্মচারী নুরুদ্দিনের দুই ছেলে সাব্বির ও জুবায়ের মারা যান এ ঘটনায়। সাব্বির নারায়ণগঞ্জ কলেজে অনার্সে, জুবায়ের নারায়ণগঞ্জ তোলারাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেন। দুই সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ নুরুদ্দিন। অন্যদিকে সাত বছরের শিশু জুবায়েরের মায়ের কান্না থামানো যাচ্ছে না। শুক্রবার রাতে ‘মা, টিভি বন্ধ কোরো না’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় জুবায়ের। সাত বছরের শিশুটি বাবার সঙ্গে বাড়ির কাছের মসজিদে যাবে নামাজ আদায়ে। ফিরে এসে আবার বসে যাবে টিভির সামনে। তাই টিভি বন্ধ করেননি মা। মিনিট বিশেক পরই মা জানতে পারেন সেই হৃদয়বিদারী খবর, তাঁর নাড়িছেঁড়া মানিক আর টিভি দেখতে আসবে না। একমাত্র সন্তান কখনই আর ফিরবে না বাসায়। বিস্ফোরণের পর জুবায়েরের মা রহিমা খাতুন জানতে পারেন তাঁর ছেলে যে মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেছে, সেখানে আগুন লেগেছে। পাগলের মতো মসজিদের দিকে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন মসজিদ বিধ্বস্ত। সেখানে পড়ে রয়েছে জুবায়ের। কুদ্দুস ব্যাপারীর বয়স ছিল ৬৫ বছর। সে কারণে চেয়ারে বসেই মসজিদে নামাজ আদায় করতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম ফতুল্লা তল্লা মসজিদ এলাকার এই মুরুব্বি। বিস্ফোরণের পর চেয়ারটি থেকে অনেকটা টেনে হিঁচড়ে বের করতে হয় কুদ্দুস ব্যাপারীকে। চেয়ারটির বেশির ভাগ স্থানেই লেগে আছে তাঁর পোড়া চামড়া। চেয়ারের নিচের স্থানটি ফুটো হয়ে যায়। বিস্ফোরণে কুদ্দুস ব্যাপারীর শরীরের পেছনের অংশ পুড়ে যায়। গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারটি মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে মসজিদের বাইরে পড়ে আছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর