রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ভারসাম্যহীনতার আশঙ্কা সরকারি আয়-ব্যয়ে

বেড়েছে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়, বাড়ছে না রাজস্ব ব্যয় সংকোচন নীতি ধরে রাখতে পারছে না সরকার

মানিক মুনতাসির

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, যা টার্গেটের তুলনায় অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এই সময়ে সরকার চাহিদা মেটাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা শুধু ধারই করেছে ব্যাংক খাত থেকে। কভিডের কারণে বেড়েছে সরকারের পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়। কিন্তু বাড়ছে না রাজস্ব আয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড় স্থগিত করেছিল সরকার। কিন্তু সেই ব্যয় সংকোচন নীতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে আবারও এসব প্রকল্পে অর্থছাড় প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টেও রাজস্ব আদায়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হয়নি। কিন্তু ব্যয়ের লাগাম টানতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। ফলে সরকারি আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য অর্থ বিভাগ থেকে ৩১ আগস্ট বাজেট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন  অগ্রগতি পরিবীক্ষণের জন্য একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।

সার্কুলারে বলা হয়, অর্থবছরের শুরুর দিকে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে অর্থবছরের প্রথমার্ধে রাজস্ব আহরণে থাকে ধীরগতি। এমনকি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছাড়া অন্যান্য আইটেমের বিপরীতে ব্যয়ের পরিমাণও কম। এতে বাজেটের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে না পারায় সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে বছরের শেষে এসে সরকারকে অপরিকল্পিত ঋণের দায়ভার নিতে হয়, যা বাজেটের শৃঙ্খলা নষ্ট করে। সূত্র জানায়, চলমান কভিড-১৯ মহামারীর কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামগ্রিক অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপর্যস্ত এই অর্থনীতিকে টেনে তুলতে নতুন বাজেট এবং এক লাখ কোটি টাকার বেশি একটি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে সরকার। এতে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। দেশের রপ্তানিবাণিজ্যও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ছে না কিছুতেই। ফলে গত অর্থবছরের লক্ষাধিক টাকার রাজস্ব ঘাটতির সঙ্গে চলতি বছরও বিশাল আকারের রাজস্ব ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও নতুন করদাতা অনুসন্ধানসহ এনবিআর থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে রাজস্ব বাড়াতে। এর পরও চলতি বছরের শুরুতেও বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতিতে পড়েছে এনবিআর, যা মূলত সরকারের আয়-ব্যয়ের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি করছে। এতে অর্থবছর শেষে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে সরকারি আয় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা। এমন আশঙ্কাই করছে অর্থ বিভাগ। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলোকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১২ হাজার ৩৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৩৭৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম মাসেই লক্ষ্যের চয়ে ৭ হাজার ৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৩৫ ভাগ কম হয়েছে। গত বছর জুলাই মাসের চেয়ে কম আদায় হয়েছে ২২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। জানা গেছে, সরকারের ভিতরের অর্থ সংকটের তীব্রতা কাটছে না। আবার সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও বেড়েছে। কিন্তু কভিড-১৯ মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকারের খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি আয়ও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে বলা যায় একরকম ব্যাংক থেকে ধার করেই চলছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সংকট মেটাতে সরকার প্রতিদিন ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ২৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে, যা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে এটা তো নতুন নয়। তবে এবার নিশ্চয়ই অনেক বেশি পরিমাণে কমেছে। এমন একটা ধাক্কা আসবে তা তো আগেই বোঝা গেছে। কেননা কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সারা বিশ্বেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা বিরাজ করছে। এ সংকট সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। ফলে আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়েছে। এতে করে সরকারেরও আয় কমেছে। সরকার যে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে, এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এর আগে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে সরকারের অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে, যা এই সংকটকালে কাজে লাগবে। এতে আয়-ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাও সহজ হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর