সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তবু শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

করোনাকালেও দুর্ঘটনা, উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি, যাত্রী তোলা হচ্ছে যত্রতত্র, স্বেচ্ছাচারিতা চালক-হেলপারদের, সড়ক তদারকিতে মাত্র আট ম্যাজিস্ট্রেট

শিমুল মাহমুদ ও মাহমুদ আজহার

তবু শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

স্টপেজে থামছে না বাস। ঝুঁকি নিয়েই যত্রতত্র ওঠা-নামা যাত্রীদের। রাজধানীর বাড্ডায় প্রগতি সরণিতে গতকাল -রোহেত রাজীব

বনানীর ফাঁকা রাস্তায় গত শুক্রবার আফরোজা পারভীন (৫৮) নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী কর্মকর্তার পায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দিয়েছেন এক চালক। বিপিএল সুপার নামের ওই বাসটিতে করেই নরসিংদী থেকে ঢাকায় ফিরেছিলেন তিনি। সেই নারী কর্মকর্তা এখন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, বাসের চাকায় থেঁতলানো তার ডান পা কেটে ফেলতে হতে পারে। ওই বাসের চালক ও হেলপার দুজনই পালিয়ে যায়। শুধু আফরোজা পারভীন একাই নন, প্রতিনিয়ত রাজধানীসহ সারা দেশেই ঘটছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। এত কিছুর পরেও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক থেকে শুরু করে যাত্রী পথচারী কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। করোনাকালে দীর্ঘ বেকারত্বের পর রাস্তায় ফিরেও পরিবহন শ্রমিকদের আচরণ-অভ্যাসে ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন হয়নি। সড়কে ড্রাইভার-হেলপারদের স্বেচ্ছাচারিতা ও লাগামহীন মনোবৃত্তির কোনো পরিবর্তন আসেনি। গণপরিবহনে কোথাও করোনাকালের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো অনুসরণ করা হয় না। অন্যদিকে যাত্রীরাও সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করেই চলেছেন। অফিস শুরুর আগে এবং ছুটির পর গাদাগাদি করে ঝুলে বাসে চড়ছেন। তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অনেক সময় বাধা উপেক্ষা করে গাড়িতে ওঠার সময় ঘটছে দুর্ঘটনা। যাত্রী, পথচারীদের অসতর্কতা ও পরিবহন কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতায় কোনোভাবেই সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরছে না।  গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাস মালিক ও চালকদের অনিয়ম সংক্রান্ত সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানে চালকরা সংঘবদ্ধভাবে ব্যবসা করছেন, তাই মালিকরাও চালকদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। তাছাড়া আমাদের এখানে বাসচালকদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে যারা আছেন তারা ক্ষমতাহীন, তারা আগেও বাসচালকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি, এখনো পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘বাস রুট ফেঞ্চাইজি করা গেলে চালকদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে। ঢাকার গুলশান চাকা এবং হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিসের মতো বাস সেবা দেওয়া যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় চালকরা ব্যবসা করেন না। তারা থাকবেন বেতনভুক্ত। তাহলে সড়কপথের শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সড়কজুড়েই বাসের রেষারেষি, স্টপেজের বাইরে যত্রতত্র যাত্রী তোলা, চলন্ত গাড়ি থেকে যাত্রী নামিয়ে দেওয়াসহ আগের সব স্বেচ্ছাচারিতাই চলছে সমানতালে। যাত্রীরাও রাস্তায় নেমে যেন স্বেচ্ছাচারি হয়ে যান। ফুটওভারব্রিজ এড়িয়ে চলা, চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে মাঝ রাস্তায় দৌড়-সবকিছু চলছে সমানতালে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কঠোর নজরদারি ও নতুন সড়ক পরিবহন আইনের দৃঢ় বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সড়ক পরিবহনের এই নজিরবিহীন নৈরাজ্য বন্ধ হতে পারে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজধানীর মালিবাগ, মৌচাক থেকে শুরু করে রামপুরা, বাড্ডা, শাহজাদপুর, নতুন বাজার, কোকাকোলার বাস স্টপেজগুলো ঘুরে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট স্থানে কেউ বাস থামাচ্ছেন না। স্টপেজে আড়াআড়িভাবে বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে রাস্তার একপাশজুড়েই থাকে যানজট। চালকদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো সাড়া দেন না। আড়াআড়িভাবে রাখতে গিয়ে বারবার দুর্ঘটনার কবলেও পড়েন যাত্রীরা। প্রতিদিনই একাধিক বাসের কাচ ভাঙা দেখা যায় রাস্তায়। জানা যায়, করোনায় ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর গণপরিবহন চালু হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত, কল-কারখানা খুলে দেওয়ায় চাপ বেড়েছে যাত্রী পরিবহনে। এক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখা, মাস্ক না পরার প্রবণতাও বেড়েছে। রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী, ফার্মগেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাস স্টপেজে দেখা গেছে, বাসে ওঠার সময় বেশির ভাগ গাড়িতেই যাত্রীর তাপমাত্রা পরিমাপ এবং জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে না। যাত্রীদের অধিকাংশই মাস্ক পরছেন না। বাসের হেলপার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে গায়ে হাত দিয়ে যাত্রী তুলছেন। তাদের হাতে গ্লাভস নেই, অনেকের মুখে নেই মাস্কও। তুরাগ, সুপ্রভাত স্পেশাল, বিহঙ্গ, বলাকা, রাইদা, শিকড়, বৈশাখী, ফাল্গুন, অনাবিলসহ বিভিন্ন গণপরিবহনে এ চিত্র দেখা গেছে। শুরুর দিকে চালক, হেলপার ও যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করলেও এখন খুবই কম দেখা যায়। অধিকাংশ যাত্রীবাহী বাসে এখন আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা হয় না। শুধু দুই পাশে সিটেই নয়, গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হচ্ছে গাড়িতে। কোনো কোনো বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। অন্যদিকে কোনো কোনো রুটে গণপরিবহনে যাত্রী এখন তুলনামূলকভাবে কম, চালকরা প্রতিটি বাসস্টপে দীর্ঘসময় ধরে বাস ফেলে রাখছেন। ফলে, বাসস্টপগুলোতে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। পেছনের গাড়ি সামনে যেতে পারছে না। আগের সব অরাজকতা আবারও ফিরে এসেছে।

বাড্ডা লিংক রোড থেকে গুলিস্তানগামী বাসযাত্রী ব্যাংকার সুজন মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অফিস আওয়ারে দেখি, দুই পাশের সিটের বাইরেও দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। গাদাগাদি করেও যাত্রী তোলা হয়। প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। হেলপারও এখন আর মাস্ক পরে না। হ্যান্ড গ্লাভসও পরে না। তারা প্রবেশপথে না দাঁড়িয়ে দরজার সামনে প্রথম সিটে বসলে ভালো হতো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শরিফ হোসেন জানান, তিনি প্রায় প্রতিদিনই শাহজাদপুর থেকে উত্তরায় তার অফিসে যান। এ পথের অধিকাংশ গণপরিবহনে এখন আর কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা ও রাজপথের মৃত্যু আবারও বেড়ে গেছে। দেশের প্রায় সব মহাসড়কেই দূরপাল্লার বাস-ট্রাকের সঙ্গে বিপজ্জনকভাবে চলাচল করছে নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর হাই কোর্ট গত বছর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ১০ জেলার মহাসড়কে তিন চাকার বাহন না চালানোর নির্দেশ দেয়। এরপর গত বছরের আগস্ট থেকে মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। এত কিছুর পরও বন্ধ রাখা যায়নি এসব অবৈধ যানবাহন। এসব ছোট যানের জন্য আলাদা লেন করার বিষয়টিও এগোয়নি। দেশের প্রায় সবকটি মহাসড়কেই ৮০-১০০ কিলোমিটার গতির বাসের পাশেই হেলেদুলে চলছে ৩০-৪০ কিলোমিটার গতির সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন, করিমন। এসব ছোট যানবাহনের কারণে মহাসড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনা, নিমসার, কাবিলা, চৌদ্দগ্রাম, ক্যান্টনমেন্ট, পদুয়ারবাজার এলাকায় দেখা যায়, মহাসড়কের ওপরই সারি সারি সিএনজিচালিত ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। চালকরা ডেকে ডেকে যাত্রী তোলেন। ওই এলাকায় মহাসড়কের ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী দুটি লেনই অবৈধ তিন চাকার যানবাহনের দখলে। যার কারণে এই অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে, ঘটে দুর্ঘটনাও। এ ছাড়া জরুরি যান চলাচলে সৃষ্টি হয় প্রতিবন্ধকতা। সারা দেশেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একই চিত্র। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দূরপাল্লার বাসের একাধিক চালক বলেছেন, এসব তিন চাকার যানবাহনের অনেক চালক আছেন, তারা জানেনই না কীভাবে মহাসড়কে গাড়ি চালাতে হয়। অনেক সময় তারা হুট করে দ্রুতগতির গাড়ির সামনে চলে আসেন। যখন ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে একটি বাস চলে তখন এসব নিষিদ্ধ যান হুট করে সামনে চলে এলে আমাদের হার্ড ব্রেক করে গাড়ি থামাতেও বেকায়দায় পড়তে হয়। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান আরও জোরদার করা হচ্ছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী গণপরিবহন আগের ভাড়ায় ফিরেছে। অনেক পরিবহন শর্ত মেনে পুরনো ভাড়া আদায় করলেও কিছু কিছু পরিবহনের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গসহ কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়। যাত্রী ওঠা বা নামার ক্ষেত্রে দরজায় ভিড় এড়াতে হবে।

এদিকে রাজধানীতেও বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট শুরু হয়েছে। কিন্তু সীমিতসংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে হাতেগোনা কিছু মোবাইল কোর্টের অভিযানে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার সুযোগ কম। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বাসচালকদের যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তারাই ক্ষমতাহীন। বাস মালিক-চালকরা যে অনিয়ম করছেন তার নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর নেই। বিআরটিএ বর্তমানে মাত্র আটজন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা ট্রান্সপোর্টের কর্ণধার খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা শুধু দুর্ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এতে আরও অনেক কিছুই আছে। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়েছে বাইক ও প্রাইভেট মাইক্রোবাসে। তারা কোনো সিগনাল মানে না। বাইকে কোনো স্পর্শ লাগলেই দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসও খুব বেপরোয়া চলে। আমরা ১ সেপ্টেম্বর থেকে আগের ভাড়ায় ফিরে গেছি। ভালো কাজও হচ্ছে। তবে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে নিয়মের বাইরেও দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। রাস্তায় পুরো নিয়ন্ত্রণে শুধু আমরাই যথেষ্ট নই, এখানে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করছে। যার যার সেক্টরগুলোতে সবাই কাজ করলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সড়ক তদারকিতে বিআরটিএর আরও ম্যাজিস্ট্রেট ও হাইওয়ে পুলিশ বাড়ানো উচিত।’ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এখনো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না সড়ক পরিবহনগুলো। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। বাস মালিক-শ্রমিক, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর