সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বিডিআর বিদ্রোহ প্রসঙ্গে সংসদে প্রধানমন্ত্রী

যারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি তারাই পেছনে ছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

যারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি তারাই পেছনে ছিল

বিডিআরের বিদ্রোহের পেছনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত বিএনপি-জামায়াত ও ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টিকারীদের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা কেবল সরকার গঠন করেছি। যারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি, তারাই এর (বিডিআর বিদ্রোহের) পেছনে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিল ওয়ান-ইলেভেন যারা সৃষ্টি করেছিল তারা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসায় সবকিছু নস্যাৎ করার পরিকল্পনায় তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। একদিন না একদিন এই সত্যটা বের হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে গতকাল প্রথম দিন আনীত শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকার গঠনের ৫২ দিনের মাথায় এই ঘটনা ঘটল। ওই ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৩৩ জন সেনা অফিসার আওয়ামী লীগ পরিবারের। বিডিআরের ডিজি যিনি ছিলেন, ওই সংসদের সদস্য লুৎফুল হাই সাচ্চু, তার আপন চাচাতো ভাই। প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশে করে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন। যারওই ঘটনা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটছে সেই ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি বের হবে। এ ছাড়াও অন্য সব বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সকাল ১১টায় অধিবেশনের শুরুতে চলতি সংসদের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে সংসদে শোক প্রস্তাব আনা হয়। শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আবদুল মতিন খসরু, শাজাহান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শহীদুজ্জামান সরকার, বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা ও বিএনপির হারুনুর রশীদ। শোক আলোচনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহের সময় তার সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সততার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সাহারা খাতুনের সাহস দেখেছি বিডিআরের ঘটনার সময়। তিনি ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গিয়েছেন। রাতের বেলা সেখানে গিয়ে বিডিআর সদস্যদের আর্মড সারেন্ডার করিয়েছেন। অনেক আর্মি অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। এ জন্য তার জীবনের ওপরও হুমকি এসেছিল। কোনো সাধারণ মানুষ এই সাহস করতে পারত না। তিনি বলেন, ঘটনার পরে আমাদের চেষ্টা ছিল কোনো মতে এটাকে থামানো। অফিসার ও তাদের পরিবারগুলোকে রক্ষা করা। ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি আমার বিরুদ্ধে ১২টি মামলা দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর আরও ৫-৬টি মামলা দেওয়া হয়। তাদের প্রচেষ্টা ছিল মামলাগুলো দ্রুত চালিয়ে আমাকে শাস্তি দিয়ে দেবে। বলতে গেলে একদিন পরপর আমাকে কোর্টে হাজিরা দিতে নেওয়া হতো। আর ওই মামলার সময় সাহারা খাতুন সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতেন। মামলা পরিচালনা করতে আমাদের আইনজীবীরা এলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করত, গ্রেফতার করত। তাদের ছাড়িয়ে আনতে ছুটে যেতেন সাহারা খাতুন। এভাবে তার সাহসী ভূমিকা আমরা দেখেছি। প্রত্যেক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতেন। কোনো ভয়ভীতি তার ছিল না।  ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে ছিলেন। পঁচাত্তরে আমাদের পাশে ছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আমি বন্দী থাকাকালে আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু নিয়ে আমার ওপর দোষ চাপাল তখনো তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি সবসময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন। তিনি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, পঁচাত্তরের পর আমাকে ভারতে রিফিউজি হিসেবে থাকতে হয়েছে। নিজেদের নাম পর্যন্ত আমরা ব্যবহার করতে পারতাম না। কারণ নিরাপত্তার কারণে আমাদের ভিন্ন নামে থাকতে হতো। আমরা দুই বোন একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত অবস্থায় ওখানে (ভারতে) থাকতাম। পারিবারিক পরিবেশের একটু স্বাদ পাওয়া যেত প্রণব বাবু এবং তার পরিবারের কাছ থেকে। আর তার ধারাবাহিকতা আমৃত্যু বজায় ছিল। তার মতো একজন জ্ঞানী রাজনীতিবিদ পাওয়া খুবই মুশকিল। সব দলই তাকে সম্মান করে। তার মৃত্যু উপমহাদেশের রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হলো।

মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা বের হবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ওইটুকু একটা জায়গায় ছয়টা এসি। আবার শোনা যাচ্ছে গ্যাসের লাইনের ওপর নাকি এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটাই এখন তদন্ত করে দেখা হবে। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা সেখানে গেছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন। ওই ঘটনা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটছে সেই ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি বের হবে। এ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যুবরণকারীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছেন। প্রতিনিয়ত তিনি আমাকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন। রোগীদের অবস্থা জানাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ ঘটনার পর সারা দেশের মসজিদে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি, এর কারণটা খুঁজে বের করতে। এ ছাড়া সারা দেশের অন্যান্য মসজিদে যাঁরা অপরিকল্পিতভাবে ইচ্ছেমতো এয়ারকন্ডিশন লাগাচ্ছেন বা যেখানে সেখানে একটি মসজিদ গড়ে তুলছেন, সেটা একটা স্থাপনা করার আদৌ জায়গা কি-না, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না, নকশা করা হয়েছে কি না, সে বিষয়গুলো দেখা একান্ত প্রয়োজন। না হলে এ ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনা যে কোনো সময়ে ঘটতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শোনা যাচ্ছে গ্যাসের লাইনের ওপরেই নাকি এই মসজিদটা নির্মাণ করা হয়েছে। সাধারণত, যেখানে গ্যাসের পাইপলাইন থাকে, সেখানে নির্মাণকাজ হয় না। জানি না এটা কতটা সত্য। জানি না রাজউক এটার পারমিশন দিয়েছে কি না। কারণ, এখানে পারমিশন তো দিতে পারে না, দেওয়া উচিত নয়। এতে সব সময় আশঙ্কার ব্যাপার থাকে। সেটাই এখন তদন্ত করে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, আজকাল সবার টাকা-পয়সাও হয়েছে, দান খয়রাতও করছে, এয়ারকন্ডিশনও দিয়েছে। কিন্তু সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ কতটা লোড নিতে পারবে, সেই ক্যাপাসিটি ছিল কি না, সার্কিট ব্রেকার ছিল কি না, সব বিষয় কিন্তু দেখতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে কিছু করতে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

সংসদের নবম অধিবেশন শুরু, শোক প্রস্তাব গৃহীত : স্বাস্থ্যবিধি মেনে একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশন গতকাল শুরু হয়েছে। অধিবেশন আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। চলতি অধিবেশনে সংসদে বিবেচনার জন্য নতুন তিনটি বিলসহ মোট ১৪টি সরকারি বিল রয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর জন্য ২৭টি ও অর্থমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীর জন্য তারকা চিহ্নিত ও তারকা চিহ্নবিহীন ৬৬১টি প্রশ্ন জবাবের জন্য সংসদের বিবেচনায় রয়েছে। সংসদের এসব দৈনন্দিন কার্যক্রম অনুযায়ী চলমান সংসদের স্থায়িত্বকাল নির্ধারিত হবে বলে জানা গেছে।

 

গতকাল চলমান সংসদের এমপি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মো. ইসরাফিল আলম এবং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রী প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এর আগে শোক প্রস্তাবের ওপর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নেন।

দেশে-বিদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এসি বিস্ফোরণ ও লেবাননে বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতিও শোক জানায় সংসদ। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ, এইচ এম এ গাফ্ফার, আবুল কাশেম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান, টি এম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, সাবেক হুইপ মো. আশরাফ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য আজিজুর রহমান, আ ন ম নজরুল ইসলাম, শেখ মো. নুরুল হক, এ টি এম আলমগীর, সুলতান উদ্দিন ভূঁইয়া, শাহজাহান আলী তালুকদার, সাইফুল আযম, কমরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিস ও ইঞ্জিনিয়ার শামছউদ্দিন আহমদ, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্ত রঞ্জন দত্ত, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, প্রতিরক্ষা সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, আইন সচিব নরেন দাস, সাবেক আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক দুলাল, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, সাংবাদিক কামাল লোহানী, সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক রাহাত খান, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকরামুজ্জামান, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল, ভাষা সংগ্রামী ডা. সাঈদ হায়দার, একুশে পদকপ্রাপ্ত আলাকচিত্রী সাইদা খানম, সংগীত ব্যক্তিত্ব সুরকার আলাউদ্দিন আলী, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, ভাস্কর মৃণাল হক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব বরকতউল্লাহ, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একান্ত সচিব ও ছোট ভাই আবদুল হাইয়ের মৃত্যুতে সংসদ শোক জানায়।

পরে মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করে সংসদে এক মিনিট নীরবতা পালন ও তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। পরে সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের অন্যান্য কার্যক্রম স্থগিত করে সংসদের বৈঠক মূলতবি করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর