সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঝুঁকিতে চিকিৎসাধীন সবাই

শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় বাঁচানো কঠিন, অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের

নিজস্ব প্রতিবেদক ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

ঝুঁকিতে চিকিৎসাধীন সবাই

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৩ জন। এরা প্রত্যেকেই এখন ঝুঁকিতে রয়েছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, তাদের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এদিকে এ ঘটনায় ফতুল্লা থানার এসআই হুমায়ুন কবির শনিবার ‘অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেন বলে জানান ওসি আসলাম হোসেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, মসজিদ কমিটি, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার কারণে এই আগুনের সূত্রপাত এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ঘটনাটি তদন্ত করছে পৃথক ৫টি তদন্ত কমিটি।

মারা গেলেন ২৫ জন, সংকটাপন্ন ১৩ : গতকাল দুপুরে  শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, সবাই ৭০, ৮০ ও ৯০ শতাংশের ওপর পুড়ে গেছে। কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাদের অবস্থা অনেক খারাপ বলে মনে করছি। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন রোগীদের সর্বাত্মক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য।

তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। সরকারপ্রধান সব সময় খবর নিচ্ছেন এই রোগীদের। দেশবাসীকে অনুরোধ করব দোয়া করার  জন্য। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক নেসারি (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও তার   ছেলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন (১৬), মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), জেলা প্রশাসনের কর্মচারী শামীম হাসান (৪৫),  স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ নাদিম আহম্মেদ (৪৫), তল্লার বাসিন্দা নূর উদ্দিনের বড় ছেলে নারায়ণগঞ্জ কলেজের ছাত্র সাব্বির (২১) ও মেজো ছেলে সরকারি তোলারাম ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র জোবায়ের (১৮), জুলহাস উদ্দিন (৩০), মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাটবুকদিয়া গ্রামের কুদ্দুস বেপারী (৭২), চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পোশাক শ্রমিক জুলহাস ফরাজীর ছেলে জুবায়ের ফরাজী (৭), পটুয়াখালীর গলাচিপার আবদুল খালেক হাওলাদারের ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. রাশেদ (৩০), পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৭২), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী গ্রামের জামাল আবেদিন (৪০), পোশাক শ্রমিক ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাইন উদ্দিন (১২), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. জয়নাল (৩৮), লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুকপলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে পোশাক শ্রমিক মো. নয়ন (২৭), ফতুল্লার ওয়ার্কশপের শ্রমিক কাঞ্চন হাওলাদার (৫০), শ্রমিক মো. রাসেল (৩৪), বাহার উদ্দিন (৫৫), নিজাম ওরফে মিজান (৪০)।

ঝুঁকিতে ১৩ জন : চিকিৎসাধীন ১৩ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে এখনো ১৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তারাও শঙ্কামুক্ত নয়। দগ্ধ ১৩ জনের মধ্যে ৬ জনকে আইসিইতে রাখা হয়েছে।

চিকিৎসাধীন ১৩ জন হলেন- ইমরান (৩০), মামুন (২৩), আমজাদ (৩৭), আ. সাত্তার (৪০), হান্নান (৫০), আ. আজিজ (৪০), রিফাত (১৮), নজরুল ইসলাম (৫০), মো. কেনান (২৪), আবুল বাসার মোল্লা (৫১), মনির ফরাজী (৩০), শেখ ফরিদ (২১) ও মো. ফরিদ (৫৫)। তাদের মধ্যে ফরিদ, মনির ফরাজী, কেনান, আজিজ, আমজাদ ও আবুল বাশারকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

দগ্ধ ইমরানের বোন শিল্পী বেগম জানান, তার ভাই নারায়ণগঞ্জ একটি পোশাক কারখায় কাজ করত। ওই এলাকায় আমরা থাকি সকালে ভাইকে স্যুপ খাওয়ানো  হয়েছে। এ ঘটনায় ইমরানের ভায়রা আমজাদ হোসেনও দগ্ধ হয়েছেন। এর আগে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন ৩৭ জন মুসল্লি। তাদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত ২৪ জন মারা গেছেন। বাকি ১৩ জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে মামলা দায়ের : ফতুল্লা থানার এসআই হুমায়ুন কবির শনিবার ‘অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেন বলে জানান ওসি আসলাম হোসেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, মসজিদ কমিটি, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলার কারণে এই আগুনের সূত্রপাত এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, ‘ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, তিতাস, ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর যদি কারও বিরুদ্ধে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যায় তখন তার বিরুদ্ধে এ মামলায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া তদন্তের পরই আরও বিস্তারিত বলা যাবে।’

নয়ন ফিরলেন লাশ হয়ে! : লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে এসি বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের দিনমজুর মেহের আলীর বড় ছেলে শুকুর আলী নয়ন (২৭)। নয়ন সেখানে একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। ইচ্ছে ছিল এবার গ্রামে এসে ব্যবসা শুরু করবেন কিন্তু তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। নারায়ণগঞ্জ থেকে গতকাল ভোরে বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তার বন্ধু শুভ শামীম বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের গার্মেন্টে ছুটি হয়। নয়ন বাসায় ফিরে নামাজ পড়তে মসজিদে এসেছিল। নামাজ পড়ে সে ফিরলে আমাদের একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ শুনলাম বিস্ফোরণ, মসজিদে আগুন লাগছে। গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমরা ওই মসজিদের মেসেই থাকি। তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে অবাক হই, ভয় পেয়ে যাই। ওখানে না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসি। সেখানে ওর লাশ ও মোবাইলটি পাই। এরপর ওর বাড়িতে কথা হয়। ওর ভগ্নিপতি ও মা শনিবার সকাল ৬টায় ঢাকায় পৌঁছে লাশ বুঝে নেন।

বিএনপির তৈমুরের রিট : নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহত প্রত্যেকের জন্য ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাই কোর্টে রিট করেছেন অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। ৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে তৈমুর আলম খন্দকার হাই কোর্টে বিচারপতি জে বি এম ও বিচারপতি খায়রুল আলমের আদালতে ওই রিট আবেদন করেন। আদালত ৭ সেপ্টেম্বর সোমবার শুনানির দিন ধার্য করেন।

অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। তিনি জানান, এ ঘটনায় নিহত ও আহত প্রত্যেককে ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আদালতে রিট করেছি। সোমবার শুনানি হবে। আমরা আশা করি আদালত আমাদের আবেদন শুনবে। কারণ এটা মানবসৃষ্ট একটি দুর্ঘটনা। গাফিলতির কারণেই এ বিস্ফোরণ থেকে এতগুলো মানুষ হতাহত হয়েছে। যাদের জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের মধ্যে এতই সিস্টেম লস যে টাকা ছাড়া কিছু বুঝে না। এটা সরকারের ব্যর্থতা। যে কোনো অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই। এই ঘটনার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

জাফরুল্লাহর ক্ষোভ : মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় সরকার সতর্ক হলে মৃত্যুর ঘটনা আরও কমতে পারত বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দুপুরে ফতুল্লার তল্লা মসজিদ পরিদর্শন করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সরকার আরেকটু সতর্ক হলে আরেকটু ব্যবস্থা নিলে মসজিদে বিস্ফোরণে ২৪ জনের জায়গায় অর্ধেক লোক কম মারা যেত। সরকার এটা ঘটায়নি, কিন্তু তাদের ব্যর্থতা। তারা প্রত্যেক সময় অর্ধেক কাজ করে রেখে দেয়। আমার কষ্ট লেগেছে এখান থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে। এই যে কষ্টটা, অকল্পনীয়। আগুনে পোড়ার যে ব্যথাটা, আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন না। এখানে যে চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ এত বড় একটা জেলা শহর উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে ইনজেকশন দেওয়া। তাহলে ব্যথা থাকত না। এখন ওষুধ বেরিয়েছে অথচ পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। যদিও এর দাম খুব বেশি নয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর