মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ গ্যাস লাইনের ছড়াছড়ি

মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

জিন্নাতুন নূর

দেশজুড়ে মাকড়সার জালের মতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবৈধ গ্যাস লাইন ছড়িয়ে আছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশে গ্যাসের অবৈধ লাইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নৈরাজ্য চলে আসছে। সংশ্লিষ্ট মহল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা অবৈধ গ্যাস সংযোগের গ্রাহক। ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোতে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে পাতলা প্লাস্টিকের পাইপ গাছের উপর দিয়ে টেনে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এই সংযোগ শুধু আবাসিকেই নয়, বড় বড় শিল্প কারখানাতেও দেওয়া হচ্ছে। আর অবৈধভাবে বসানো এসব লাইনের কারণে শুধু যে গ্যাস চুরি হচ্ছে তা নয়, গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থাও ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে মানুষের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে তিতাসের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও বলা হয়েছে। তার পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্যাসের অবৈধ সংযোগের লাইন নিয়ন্ত্রণে- হয় বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে অথবা অবৈধ বা বৈধ লাইনগুলোকে মাসিক বিলিং সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগের ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে শিগগিরই একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। আর এই প্রক্রিয়ায় প্রায় কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তিতাস গ্যাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা। এসব অবৈধ সংযোগ থেকে এককালীন টাকা পাচ্ছে তিতাস গ্যাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবার কোথাও কোথাও এককালীন টাকা নেওয়ার পরও মাসিক বিল নিচ্ছে একটি চক্র। আর এর ভাগ তিতাস গ্যাসের কর্মীরাও পাচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের চাপে কোথাও লাইন কাটা হলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে কিছুদিন পরই আবার অবৈধ সংযোগ নেওয়া হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে চলছে এই গ্যাস চুরির মহাযজ্ঞ। যার জন্য রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সূত্র জানায়, ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর সব উপজেলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। রাজধানীর পূর্ব থেকে বৃত্তাকারে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর, টঙ্গী, ঢাকার ধামরাই, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন গ্রামে আবাসিক ও শিল্পকারখানায় অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মানিকগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরেও এখন  অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জেও তিতাসের অবৈধ পাইপলাইন আছে। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণ বেশি। গত বছর রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তিটি আগুনে পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়ার পর দেখা যায় যে এই বস্তি ঘরের নিচ দিয়ে টানা হয়েছিল গ্যাসের অবৈধ লাইন। প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে জোড়াতালি দিয়ে অরক্ষিতভাবে এসব লাইন টানা হয়। এজন্য বস্তির বাসিন্দাদের বাড়িওয়ালাকে এক চুলার জন্য পাঁচশ ও দুই চুলার জন্য এক হাজার টাকা দিতে হয়।  জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন,  ঢাকা শহরে যে গ্যাস পাইপ লাইন নেটওয়ার্ক আছে তা একটি টিকিং টাইম বোম। এখানে কত জায়গায় যে লিকেজ আছে তা কেউ জানে না। আমাদের এখানে যখন একটি ঘটনা ঘটে তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন মেরামত করে। কিন্তু এতে কোনো লাভ নেই। এ ধরনের অসংখ্য অবৈধ লাইন আছে যে স্থানে ছোট-বড় লিকেজ হচ্ছে। এজন্য দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে। এর আওতায় পুরো পাইপ লাইনটিকে সার্ভে করে অবৈধ সংযোগের , মতো বিপজ্জনক পয়েন্ট চিহ্নিত করে তা উচ্ছেদ এবং পুরানো লাইনগুলোও একইসঙ্গে পরিবর্তন করতে হবে। আর এমনটি করা না গেলে কেউই বিপদমুক্ত হতে পারবে না। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, একদিক দিয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, আরেকদিক দিয়ে সংযোগ লাগানো হয়। নারায়ণগঞ্জের আশপাশের এলাকায় প্লাস্টিকের পাইপ গাছের উপর দিয়ে বিপজ্জনকভাবে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন অর্থের বিনিময়ে এই অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন। আর এতে তিতাস কর্তৃপক্ষের বেশ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা, মধ্যস্বত্বভোগী এবং কিছু অসাধু উপকারভোগী জড়িত।  শুধু আবাসিকেই নয়, বড় বড় শিল্প কারখানাতেও এই অবৈধ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ নিয়ন্ত্রণে হয় বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে অথবা অবৈধ বা বৈধ সব লাইনকে মাসিক বিলিং সিস্টেমের আওতায় আনতে হবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও জানান, যারা অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে জড়িতদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে। তিতাসের ৫০ শতাংশ লোক বের করে দিতে হলে তাও করা হবে। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল-মামুন বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের এলাকাগুলোতেও একইসঙ্গে অভিযান চালানো হবে। ঢাকা শহরে যে অভিযান পরিচালিত হয় তাতে দেখা যায়, নতুন করে যে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়েছে এমন নয়, পুরানো লাইন থেকেও নতুন করে সংযোগ নেওয়া হচ্ছে। আবার ডেভেলপারকে দিয়ে স্থাপনা ভেঙে নির্দিষ্ট লাইনের চেয়ে বেশি লাইন দেখিয়েও অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। তবে অবৈধ গ্যাস সংযোগে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কি না তা আমরা বুঝতে পারছি না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, গ্যাস লাইনের অবৈধ সংযোগ সমূলে উৎপাটন করা হবে। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, যত শক্তিশালী গ্রাহকই হোক না কেন অবৈধ সংযোগের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকা ছাড়াও এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং নরসিংদীতে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের কাজ করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর