রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রমরমা গ্যাস বাণিজ্য

সরকারি দলের ওয়ার্ড নেতা জনপ্রতিনিধি ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য, সাবেক এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাণিজ্যে জড়িত, অবৈধ সংযোগ নিয়ন্ত্রণে এলপিজিকে আকর্ষণীয় করতে হবে

জিন্নাতুন নূর

ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণে সারা দেশের গ্যাস সংযোগের রমরমা বাণিজ্য। গৃহস্থালি গ্যাস সংযোগের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মী ও জনপ্রতিনিধি অবৈধভাবে পাইপলাইন সংযোগের মাধ্যমে ‘ওপেন সিক্রেট’ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট গ্যাস বিতরণ সংস্থার একশ্রেণির কর্মকর্তা। ১০ বছর ধরে এই অবৈধ গ্যাস বাণিজ্যের ফলে সারা দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি বিস্তৃত হয়েছে। মূল্যবান গ্যাস অনুৎপাদন খাতে ব্যবহারে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের জ্বালানি নিরাপত্তা। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা এই  অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বন্ধ করে এলপিজিকে গ্রাহকের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাসের মতোই সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। গৃহস্থালি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করে অবৈধ গ্যাস বাণিজ্যের অরাজকতা বন্ধ করতে হবে।    

কার্যত ২০০৯ সাল থেকেই সরকার সারা দেশে বাসাবাড়িতে পাইপলাইন গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে এলপি গ্যাসের বাণিজ্যিক ব্যবহার উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু গ্যাস কোম্পানিগুলোর দুর্নীতিবাজ কর্মী ও স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি সরকারের নিষেধাজ্ঞা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। 

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা ও তার আশপাশে যেসব এলাকায় শহর বড় হচ্ছে সেখানে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি এখন এক প্রকার রাজনৈতিক বিষয়গুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন দুই পক্ষই অবৈধ আর্র্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত এ কাজটি করছেন। এতে সরকার প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন গ্যাসের বৈধ গ্রাহকরা।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, লাইন স্থায়ী করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদন ফরম পূরণ করে ঢাকার আশপাশের এলাকায় দেওয়া হচ্ছে গ্যাস লাইনের অবৈধ সংযোগ। আর অবৈধ এই গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কাজে জড়িত সরকারি দলের ওয়ার্ড নেতা, জনপ্রতিনিধি, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য থেকে পঞ্চায়েত কমিটির লোকজনও। এই তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানরাও। এমনকি গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সংযোগ সরবরাহকারী টিমও অবৈধ এই কর্মকা-ে জড়িত। এদের মধ্যে রয়েছে কলমিস্ত্রি, পাইপ মিস্ত্রি, মাটির জোগালি টিম। এ ছাড়া সরাসরি গ্যাস কোম্পানির হয়ে কাজ করা ঠিকাদাররাও এ কাজে জড়িত। তারা মূলত মূল লাইন থেকে কীভাবে গ্যাস সংযোগ দিতে হয় সেই কৌশল শিখিয়ে দেয়। বিস্ময়কর হলেও কিছু এলাকায় গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সময় ব্যবহার করা হচ্ছে তিতাস গ্যাসের মতো দেখতে হুবহু নকল জিপ। এর সামনে লেখা থাকে তিতাস কর্তৃপক্ষ। প্রথম দেখে এটি বোঝার উপায় নেই যে, সংযোগের কাজ করছে কোনো অবৈধ কর্মী। আবার শুধু অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়েও থামছে না গ্রাহক। নতুন বিপত্তি হিসেবে কিছু কিছু এলাকায় গ্রাহকরা এখন অবৈধভাবে বড় রাইজার ব্যবহার শুরু করেছেন। এরই মধ্যে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বৈধ গ্যাস সংযোগ গ্রাহকরা অবৈধভাবে বড় রাইজার সংযোগ নিতে শুরু করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিতাস অনুমোদিত একশ্রেণির অসাধু ঠিকাদার মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বড় রাইজারগুলোর সংযোগ দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাসের অবৈধ পাইপলাইনগুলো টেকনিক্যাল নিয়ম মেনে সঠিকভাবে স্থাপন করা হচ্ছে না। প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে এবং গাছের ওপর দিয়ে অবৈধ এই লাইন নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে আধা ইঞ্চি পাইপ দেওয়ার কথা সেখানে কোয়ার্টার ইঞ্চি দেওয়া হচ্ছে। আবার পাইপের মানও ভালো না। অবৈধ গ্যাস পাইপলাইন হিসেবে পানির পাইপলাইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার গ্যাস পাইপলাইনের বাইরে একটি কোটিং দেওয়ার কথা থাকলেও যখন এই লাইনগুলো লাগানো হয় তখন তা মানা হয় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য সরকারকে বড় ধরনের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ জন্য প্রতিটি বৈধ সংযোগকারীকে প্রি-পেইড মিটার কিনতে বাধ্য করতে হবে। দাম বেশি হওয়ায় সরকার গ্রাহকদের গ্যাসের প্রি-পেইড মিটার দিতে পারছে না। এক একটি ভালো মানের চীনা কোম্পানির গ্যাসের প্রি-পেইড মিটারের দাম ১৫ হাজার টাকা। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। যারা নতুন গ্যাস সংযোগ চাইবেন তাদের ১৫ হাজার টাকা দিয়ে প্রি-পেইড মিটার কিনতে হবে আর যে গ্রাহকরা মিটার ছাড়া সংযোগ রাখবেন তাদের মাসিক বিল বাবদ ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। আর এমনটি করা গেলে অনেকেই এলপিজি গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। আবার যারা প্রি-পেইড মিটার ব্যবহার করবে তাদের খরচ মোটামুটি ১৫০০ টাকার মধ্যে নিয়ে আসতে পারবেন। এভাবে গ্যাস মার্কেটের মধ্যে ব্যালেন্স করতে হবে। তা না হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা সম্ভব নয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম তামিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন গ্রাহকরা। এখানে যে দিচ্ছেন তিনি অবৈধভাবে দিচ্ছেন আবার যে সংযোগ নিচ্ছেন তিনিও অবৈধভাবে নিচ্ছেন। এ জন্য গ্যাসের অবৈধ সংযোগ কমাতে আমাদের এলপিজি গ্যাসকেও গ্রাহকের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো দামসহ অন্যান্য দিক দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। অথবা গ্রাহকের কাছে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনের আকর্ষণ কমাতে হবে। অর্থাৎ এলপিজি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে মূল্য ব্যবধান কমাতে হবে। তা না হলে অবৈধ সংযোগ আজকে কাটলে তা আবার কালকে লাগানো হবে। জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে এক একটি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকায়। আবার অঘোষিত অবৈধ সিন্ডিকেট মাস শেষে গ্যাস বিলও নিচ্ছে অবৈধ গ্রাহকদের কাছ থেকে। মূলত নারায়ণগঞ্জ শহরের বালুর মাঠ এলাকায় অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাসের কেন্দ্রীয় অফিসের কাজিম নামে এক শ্রমিক নেতা পুরো জেলার জোনাল অফিসগুলোতে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার কাজটি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নেতার মাধ্যমেই তিতাসের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে যায় অবৈধ সংযোগের মূল অর্থ।

সাভার এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগে তিতাসের ঠিকাদার ও স্থানীয় দালালরা প্রতিটি বাড়ি মালিকের কাছ থেকে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সাভারের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, যুবলীগ নেতা, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা, মেম্বার, চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালীদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিচ্ছেন বাড়ির মালিকরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ পেতে বছরের পর বছর ঠিকাদার ও তিতাস কর্তৃপক্ষের পেছনে ঘুরতে হয়। আবার সাভারে ছোট রাইজার খুলে ফেলে বড় রাইজার প্রতিস্থাপন করে তিতাস অনুমোদিত একশ্রেণির অসাধু ঠিকাদার লাভবান হচ্ছেন। আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউপির কোনাপাড়া এলাকার যুবলীগের আহ্বায়ক আমির হোসেন জয় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে, এই যুবলীগ নেতা অবৈধভাবে ২০০ ফুট বিতরণ লাইন ও ৭০০ ফুট সার্ভিস লাইন নির্মাণ করেন। তিনি কয়েকশ বাড়িতে অবৈধ সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন। এ ছাড়াও আশুলিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাকির হোসেনও এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত। গাজীপুরেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাতের আঁধারে বাসাবাড়িতে টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস লাইনের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে অবৈধ গ্যাসের প্রতিটি সংযোগের জন্য প্রথমে নেওয়া হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। আর প্রতি মাসে গ্রাহকপ্রতি ‘বিল’ তোলা হচ্ছে ১ হাজার টাকা করে।

রূপগঞ্জের বরাবো এলাকার মহিউদ্দিন মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিতাসের ঠিকাদার আবদুল ওয়াদুদ মিয়া আমার বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। অবৈধভাবে আমার বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত বৈধ করে দেওয়ার কোনো নাম নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিতাসের বিতরণ ব্যবস্থায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন রয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জে রয়েছে ১৮০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি অবৈধ পাইপলাইন নারায়ণগঞ্জ সদর এলাকায়। এ ছাড়াও রূপগঞ্জ, বন্দর, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ উপজেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রাহক গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়েছেন। তালিকায় আরও আছে, মুন্সীগঞ্জ সদর ও গজারিয়ার নাম। এখানে অবৈধ লাইন রয়েছে ৩১ কিলোমিটার। খোদ ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, ডেমরা, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, কড়াইল বস্তি, বনানীর বিটিসিএল এলাকা, জামগড়া, ধলপুর, আমতলাসহ কয়েকটি এলাকায় ২২ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাসলাইন রয়েছে। আর গাজীপুরে রয়েছে ১৩ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস লাইন। এর বাইরে নরসিংদীতেও কিছু অবৈধ পাইপলাইন আছে। শুধু নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচটি উপজেলায় রয়েছে তিতাসের পাইপ দ্বারা পরিচালিত প্রায় ১১ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ। রূপগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার অবৈধ আবাসিক ও ক্ষুদ্র শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর