মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ওয়াহিদার সুস্থতার পরই খুলতে পারে সব জট

ইউএনও ও বাবার ওপর হামলা এখনো রহস্যাবৃত

নিজামুল হক বিপুল

ওয়াহিদার সুস্থতার পরই খুলতে পারে সব জট

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। যদিও র‌্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে দুই ধরনের বক্তব্য এসেছে। প্রথমটি ছিল চুরির আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যক্তিগত আক্রোশ। কিন্তু এর কোনো ঘটনাই বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রশাসনের লোকজন। সাধারণ মানুষের কাছেও নানা প্রশ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব রহস্যের জট খুলতে পারে ওয়াহিদা সুস্থ হয়ে ওঠার পর। তিনিই সব বলতে পারবেন, কে বা কারা, কেন তার ওপর হামলা চালিয়েছে। তাই তার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকায় ইউএনওর সরকারি বাসভবনে ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। ইউএনওকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেয় তারা। বর্তমানে ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ওয়াহিদা খানম। তার বাবাকেও ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে উন্নত চিকিৎসার জন্য। ইউএনওর ওপর হামলার এ ঘটনায় প্রথমে র‌্যাব ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা যুবলীগের সদস্য (বহিষ্কৃত) আসাদুল ইসলাম, শিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা, নৈশপ্রহরী নাহিদ হোসেন পলাশ, রংমিস্ত্রি নবীরুল ইসলাম ও সান্টু চন্দ্র দাসকে আটক করে।

৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, আসাদুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, চুরির উদ্দেশ্যে ইউএনওর বাসায় ঢুকে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। এরপর পুলিশ       জানায়, ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে ইউএনও আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশ জানায়, ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরের বরখাস্ত হওয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রবিউল ইসলাম স্বীকার করেছেন ঘটনার জন্য তিনিই দায়ী। পুলিশ বলছে, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রবিউলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য শনিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বরখাস্ত হওয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রবিউল ইসলাম দিনাজপুরের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে ক্ষোভের কারণে নিজেই ইউএনওর ওপর হামলা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় দুই আসামির কাছ থেকে দুই রকম বক্তব্য আসায় এ নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকের মধ্যেই সন্দেহ ও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ৫ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, এটি চুরির ঘটনা নয়। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতেই চুরির গল্প সাজানো হয়েছে। আর পুলিশের কাছে দেওয়া রবিউলের স্বীকারোক্তির পর গত দুই-তিন দিনে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, এটিও বিশ্বসযোগ্য নয়। অনেকেই বলছেন, এ হামলার আসল বা নেপথ্যের ঘটনা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউএনও সুস্থ হয়ে উঠলেই সব রহস্যের জট খুলে যাবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, আদৌ প্রকৃত ঘটনা বের হবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। তবে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে হবে। অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হেলালুদ্দীন বলছেন, প্রথমে এক দিনের মাথায় র‌্যাব যেভাবে এটাকে চুরির ঘটনা বলেছিল, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ইউএনওর বাসা থেকে কোনো কিছু চুরি যায়নি। আর এখন বিষয়টি নিজে উদ্যোগী হয়ে দায়িত্ব নিয়ে তদন্ত করছেন ডিআইজি। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে যাকে (রবিউল) গ্রেফতার করা হয়েছে, তার কাছে স্বীকারোক্তিও পাওয়া গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এখন যেটা বলা হচ্ছে এর মধ্যে সত্যতা রয়েছে। এর পরও তদন্তের পর সব জানা যাবে।’ তিনি বলেন, সিসি ফুটেজ, ঘটনার পারিপার্শি¦কতা, আসামি রবিউলের বর্ণনা সবই মিলে যাচ্ছে। এ ঘটনা একজনই ঘটিয়েছেন। এখানে অনেক লোক ছিল না বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার সচিব। এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি বলেন, ইউএনও এবং তার বাবা সুস্থ হলে তাদের জবানবন্দি নেওয়ার পর আরও নেপথ্যের কাহিনি জানা যাবে।

দ্রুত উন্নতি হচ্ছে ওয়াহিদার, বাবার অবস্থা জটিল : ইউএনও ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে। তিনি তার ডান হাত মাথার ওপরে তুলতে পারছেন। অনুভূতি ফিরতে শুরু করেছে ডান পায়েও। তবে তার বাবার অবস্থা বেশ জটিল। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল হক গতকাল এসব তথ্য দিয়ে বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে, এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। অধ্যাপক ডা. বদরুল হক বলেন, ‘আজকে (গতকাল) তিনি ডান হাত মাথার ওপর পর্যন্ত ওঠাতে পারছেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে সাধারণত এ রকমটা ঘটে না। তার ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে।

 এটা তার সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুবই ভালো সাইন। তবে তার পা এখনো স্বাভাবিক হয়নি, প্যারালাইজড অবস্থাতেই আছে। কিন্তু পায়েও তিনি অনুভূতি ফিরে পাচ্ছেন। এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো পা স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। যেহেতু মাথা খুব সেনসেটিভ, আর সেখানেই তিনি গুরুতর আঘাত পেয়েছেন, সে ক্ষেত্রে রোগীরা সাধারণত এত দ্রুত রিকভার করে না। কিন্তু তিনি করতে পারছেন। এটা খুবই ইতিবাচক একটা দিক।’ তিনি বলেন, ‘ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে রাত ৩টার দিকে। আর আমরা তার অপারেশন করেছি পরদিন রাত ৯টায়। কিন্তু পরদিন সকালেই যদি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার অপারেশন করানো যেত, তাহলে আরও দ্রুত তার অবস্থার উন্নতি হতো। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার অপারেশন করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও মানসম্পন্ন চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু অপারেশনের পর যেসব সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, সেগুলোর ঘাটতির কারণে সেখানে তার অপারেশন করা যায়নি। যদি রংপুরেই তার অপারেশন করা যেত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এত জটিল হতো না।’ ওই হামলায় আহত হয়ে বর্তমানে একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখও (৬৫)। তার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে অধ্যাপক ডা. বদরুল হক বলেন, ‘তার দুই পা অবশ হয়ে আছে। যেহেতু তার বয়স বেশি, সে কারণেই তার সমস্যা হচ্ছে। তার আঘাতটা মূলত লেগেছে ঘাড়ের পেছনে স্পাইনাল কর্ডে। এ কারণেই এখনো তার শারীরিক অবস্থা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। তার চিকিৎসায় ১২ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড তার এমআরআইসহ অন্যান্য চিকিৎসার বিষয়ে আলোচনা করেছে। ইতিমধ্যে তার এমআরআই করানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তারও অপারেশনের দরকার হতে পারে। তবে আমরা তাড়াহুড়ো করছি না। সবকিছু দেখে বিবেচনা করে এরপর তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা হয়। পরদিন সকালে তাদের প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর ওমর আলী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে ১২ সেপ্টেম্বর তাকেও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে আনা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর