শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় বিপাকে পাঁচ রোগে আক্রান্তরা

কিডনি, লিভার, হৃদরোগ শ্বাসকষ্ট, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিপাকে পড়েছেন কিডনি, লিভার, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্তরা। নিয়মিত চিকিৎসা নিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন অনেক রোগী। করোনা থেকে মুক্তি মিললেও অনেকের ফুসফুসে জমছে পানি, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঘটনাও ঘটছে। শ্বাসকষ্টের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে করোনা টেস্ট সনদ চাওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত হলে রক্ত জমাট বেঁধে হার্টে, মস্তিষ্কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। এতে স্ট্রোক কিংবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটছে। করোনা আক্রান্ত হলে কিডনি ও লিভারের রোগীরাও বিপাকে থাকেন। কারণ করোনা সংক্রমিত হওয়ায় শরীরে বিভিন্ন এনজাইম তৈরি হয়। এতে লিভারে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, হেপাটাইটিসও হতে পারে। কিডনিতেও প্রদাহ হয় করোনার কারণে। আগে থেকে শারীরিক জটিলতা থাকলে সমস্যা কিছুটা বেশি হয়। এজন্য বিভিন্ন রোগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠছেন বেশির ভাগ রোগী।’ 

করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন কিডনি রোগীরা। অনেক রোগীর নির্দিষ্ট সময় পরপর ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। করোনা সংক্রমণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে হাসপাতালগুলো। ডায়ালাইসিস মেশিনে অনেক সময় জানা না থাকায় করোনা আক্রান্ত কোনো রোগীর ডায়ালাইসিস করা হলে সেখান থেকে আক্রান্ত হবেন রোগী ও তার ডায়ালাইসিসে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসক, নার্স ও সহকারীরা। এ ধরনের রোগী করোনা আক্রান্ত হলে ঝুঁকিও অনেক বেশি থাকে। কিডনি রোগী মাহফুজা বেগমের স্বামী সুমন রহমান বলেন, ‘আমার স্ত্রীর দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত। সপ্তাহে দুবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হয়। আগে সরকারি হাসপাতালে কম খরচে ডায়ালাইসিস করানো যেত। কিন্তু এখন অধিকাংশ হাসপাতালে করোনা রোগী থাকায় খুব অসুবিধায় পড়েছি। অল্প কয়েকটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করানো গেলেও প্রতি সপ্তাহে সিরিয়াল পেতে ঝামেলা পোহাতে হয়। খরচের পরিমাণও অনেক বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি আমরা চিন্তায় আছি করোনা নিয়ে। কোনোভাবে করোনা আক্রান্ত হলে এ ধরনের রোগীর পরিস্থিতি কেমন হবে সেটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। চিকিৎসক আমাদের বাড়তি সতর্ক থাকতে বলেছেন। নিজেরা সতর্ক থাকছি কিন্তু হাসপাতাল তো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা।’ চট্টগ্রামে হালিশহরের বাসিন্দা আফরোজা বেগম (৫৫) চার দিন ধরে জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট বোধ করছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও দেখা দিয়েছিল করোনার উপসর্গ। বাড়ির তিনজন সদস্য করোনা টেস্ট করতে দিয়েছেন দুপুরে। হঠাৎ সন্ধ্যায় ঘরের মেঝেতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান আফরোজা বেগম। হাসপাতালে নিলে করোনা উপসর্গের রোগী হিসেবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেখে চলে চিকিৎসা। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় অবস্থার অবনতি হতে থাকে আফরোজা বেগমের। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পরে মারা যান তিনি। তার মেয়ে সাদিয়া মেহজাবিন বলেন, ‘করোনার আঘাতে আমাদের পরিবার তছনছ হয়ে গেল। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। কিন্তু চিকিৎসক জানিয়েছেন, করোনার কারণে মায়ের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছিল। মস্তিষ্কে ব্লক তৈরি হওয়ায় রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটে।’ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. আফজালুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হৃদরোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি। এ জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তবে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ মানুষের শরীরেও হৃদরোগের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখা দিচ্ছে। করোনা আক্রান্ত হলে শরীরে প্রদাহ হয়। এতে হার্টের পাম্পিং কমে যায়। হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেক রোগীর ফুসফুসে পানি আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হার্টের কার্যকারিতা অনেকটা শ্যালোমেশিনের মতো। করোনা রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। নয়তো অগোচরে শরীরে বাসা বাঁধবে দুরারোগ্য ব্যাধি। করোনা আক্রান্ত হলে মনোবল হারানো যাবে না। শক্ত মনোবল শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম ধরে রাখে।’ করোনা থেকে সুস্থ হলেও হজমে সমস্যা, ডায়রিয়ায় ভুগছেন অনেকে। করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার স্ত্রী ২১ দিনে এবং আমি ২৫ দিনে করোনামুক্ত হই। করোনা নেগেটিভ আসার পর থেকে আমরা ভীষণ দুর্বল বোধ করছি। আমার প্রায় ঘন ঘন পেটে সমস্যা হচ্ছে। হজমে সমস্যা হচ্ছে প্রায়ই। রাত ৩টা-৪টা বাজলেও ঘুম আসে না। দেড় মাস ধরে অনিদ্রা নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। আমার স্ত্রীর শরীরে অ্যালার্জি উঠে ভরে গেছে। পুরো শরীরে লাল ফোসকা উঠেছে। টানা ওষুধ চললেও কাজ হচ্ছে না। ইনজেকশনও দিতে হয়েছে। চিকিৎসক এটাকে পোস্ট কভিড সিন্ড্রম বলছেন।’ শ্বাসকষ্ট ও অ্যাজমার রোগীরা কারোনার সময়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। করোনার একটি বিশেষ উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। এ জন্য তৈরি হচ্ছে সমস্যা। করোনা আক্রান্ত হলে এ ধরনের রোগীদের শ্বাসকষ্ট আরও তীব্র হয়ে ওঠে। করোনাকালীন স্মৃতি থেকে মারিয়া জাহান বলেন, আমার পাঁচ বছর ধরে অ্যাজমা এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। করোনার শুরু থেকেই সাবধানে ছিলাম। এ জন্য চাকরিও ছাড়তে হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে করোনা টেস্ট করে যেতে হতো। তবু শেষ রক্ষা হলো না। একবার অক্সিজেন শরীরের ভিতরে টেনে নিতে সব শক্তি শেষ হয়ে আসে। ওই কষ্টের কথা মনে পড়লে আমি শিউরে উঠি।’

সর্বশেষ খবর