রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ফিকে হয়ে আসছে এ বছর ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা

জুলকার নাইন

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন ঘোষণা এলেও চলতি বছরে ভ্যাকসিন পাওয়ার আশা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। যদিও রাজনৈতিক কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনের আগে ভ্যাকসিন বাজারে আনার ঘোষণা দিয়ে বসে আছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যে এ বছর ভ্যাকসিন পাবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত সেদেশের বিজ্ঞানীরা। ট্রাম্পের রাজনৈতিক চাপে যথাযথ কার্যকারিতা ছাড়াই ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলেও শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কয়েকটি ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ট্রায়াল চলছে তার ফলাফল পেতেও আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ট্রায়ালের যে কোনো বিরূপ ফলাফল এই অপেক্ষা বাড়াবে। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আশা জাগানো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ভ্যাকসিন ‘চ্যাডক্স ১’ এর ট্রায়ালও ইতিমধ্যে দুই দফায় দীর্ঘায়িত হয়েছে। এরপর রাশিয়ার ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’ এর ট্রায়ালে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের করোনা ট্রাকারে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন অনুমোদনের আগে তিনটি ধাপের ট্রায়াল শেষে বিজ্ঞানীরা কয়েক হাজার মানুষের দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে। পরে এসব স্বেচ্ছাসেবীদের কতজন সংক্রমিত হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করেন। এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বোঝা যায়। ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গত জুনে বলেছিল, করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনকে কমপক্ষে ৫০% ভ্যাকসিনযুক্ত লোককে সুরক্ষা দিতে হবে। শুধু কার্যকারিতাই নয়, ভ্যাকসিন ব্যাপক আকারে প্রয়োগের মাধ্যমে এর পার্শ¦প্রতিক্রিয়াও গভীরভাবে দেখা হয়। কারণ ভ্যাকসিন প্রয়োগে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তাই যে কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ফেজ-৩ ট্রায়ালকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে চীন ও রাশিয়া এই ফেজ-৩ ট্রায়ালের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে ভ্যাকসিনগুলো অনুমোদন করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাড়াহুড়ো প্রক্রিয়াটি গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে।

রাশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিখাইল মুরাশকো জানান, ট্রায়ালের সময় প্রতি সাতজনের মধ্যে একজনের শরীরে দেখা গেছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ঘোষিত ৪০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ৩০০ জনের শরীরে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ ব্যক্তির শরীরে ভ্যাকসিন গ্রহণের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় পেশিতে ব্যথা ও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জানা গেছে, ২১ দিনের মধ্যে ওই স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে দ্বিতীয় দফায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। এর আগে একজনের দেহে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অক্সফোর্ডের ট্রায়াল সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার ভ্যাকসিন তা মানছে না। এখন ট্রাম্পের নির্বাচনী ঘোষণার ফলে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া ভ্যাকসিন অনুমোদনে বাধ্য করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে কানাডার ফেডারেল টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের সহ-সভাপতি ড. জোয়ান ল্যাংলি ও অ্যালান বার্নস্টেইন বলেছেন, এ ঘোষণায় কানাডায় ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। এই দ্বিধা টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বিগ্ন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কভিড ভ্যাকসিন কর্মসূচির অন্যতম প্রধান চিকিৎসাবিজ্ঞানী তথা লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সংক্রামক রোগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক হেইডি লারসনও শঙ্কিত। তিনি বলেছেন, যেভাবে তাড়াহুড়ো এবং লড়াই চলছে তাতে প্রতিষেধকের সুরক্ষা ক্ষেত্রে বড় বিপদ হতে পারে। ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব প্রসাদ রাও মনে করেন, এই তাড়াহুড়োর কারণে সুরক্ষাজনিত কোনো সমস্যা দেখা দিলে সাধারণ মানুষ ভ্যাকসিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।

পুরো বিশ্ব যখন করোনা ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করছে ঠিক সে মুহূর্তে জার্মানির গবেষণামন্ত্রী আনজা কার্লিজেক বলেছেন, আমরা স্বল্প সময়ে বা উপায়ে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে এসে কোনো ঝুঁকিতে পড়তে চাই না। আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। আমরা সেটি নিরাপদ ও কার্যকরভাবেই আনতে চাই। তিনি আরও বলেন, জার্মানি কিংবা ইউরোপ এ লক্ষেই কাজ করছে। আমি বিশ্বাস করি সব দেশেরই স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ভ্যাকসিন চূড়ান্তের কাজ করা উচিত। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের আগে ভ্যাকসিন সহজলভ্য হবে না বলেও মন্তব্য করেন জার্মান এই মন্ত্রী।

ব্যবসার জন্য ইঁদুর দৌড়ে কোম্পানিগুলো : বিজ্ঞানীরা নানাভাবে সতর্ক থাকলেও ফেজ-৩ ট্রায়ালে থাকা সম্ভাব্য ভ্যাকসিনগুলোর বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো ব্যবসা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ভ্যাকসিন তৈরিতে থাকা ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা সিইও পাস্কাল সরিয়ট বলেন, নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকায় ট্রায়াল নিয়ে আমরা সতর্ক। তবে এখনো আশা করছি, চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুর দিকে আমরা টিকা আনতে পারব।

আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে মার্কিন দুই কোম্পানি মডার্না ও ফাইজার। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরগরম ভ্যাকসিন-রাজনীতির মধ্যেই মডার্নার প্রধান নির্বাহী স্টেফান ব্যানসেল বলেছেন, তাদের ভ্যাকসিনের ফলাফল নভেম্বরের মধ্যেই জানা যাবে। হয়তো অক্টোবরেই জানা যেতে পারে; তবে এতে কিছুটা সংশয় রয়েছে। ট্রাম্পবিরোধীদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন অনুমোদনদাতা সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে (এফডিএ) হোয়াইট হাউস চাপ দিয়ে অনুমোদন করাতে বাধ্য করতে পারে। তবে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদন-ট্রায়াল ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় জোরালোভাবে সম্পৃক্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের বিজ্ঞানীরাও আগামী বছরের মাঝামাঝির আগে ভ্যাকসিন আসবে এমন আশা করছেন না। দিল্লির এইমসের ড. সঞ্জয় রাই বলেন, ‘আগামী বছরের মাঝামাঝি সময় আমরা ভারতে করোনা ভ্যাকসিনের আবির্ভাব আশা করতে পারি। তবে ভ্যাকসিন আসুক আর না আসুক আগামী বছর এই সময় সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মাস্ক এবং অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই করোনাকে হারাবে ভারত।’ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর সিংহভাগই ভারতে। ফলে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রতিষেধক তৈরি হবে ভারতেই। কিন্তু বৃহত্তম প্রতিষেধক নির্মাতা সিরাম ইনস্টিটিউটের মতো সংস্থাও বলছে, ১০ কোটি ইউনিট তৈরিতেও কয়েক বছর লাগতে পারে। সেখানে শুধু ভারতের মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে প্রয়োজন হবে ১৩০ কোটি ইউনিট। কাজেই অপেক্ষার অঙ্কটা সহজ বলে মনে করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর