মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

দৃষ্টি আল্লামা শফীর চার পদে

মাদ্রাসার মহাপরিচালক, হেফাজতের আমির, বেফাক এবং জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান

শফিকুল ইসলাম সোহাগ, ঢাকা ও মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

হেফাজতে ইসলামের আমির ছাড়াও প্রায় ৩০০ সংগঠনের প্রধান ছিলেন মরহুম আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এসব সংগঠনের মধ্যে চারটি বহুল আলোচিত এবং জনসম্পৃক্ত। আল্লামা শফীর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া চারটি সংগঠনের প্রধান কে কে হচ্ছেন এই আলোচনা এখন সর্বত্র। বিশেষ করে আলেম-ওলামাদের দৃষ্টি আল্লামা শফীর চার পদে। এগুলো হচ্ছে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলামের আমির, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এবং আল-হাইআতুল উলুয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান। আল্লামা শফী পরবর্তী এসব শূন্যপদে আসতে এরই মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কওমি শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ব্লগারদের শাস্তি এবং ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসহ ব্লাসফেমি আইন করার দাবিতে অনুষ্ঠিত লংমার্চ এসে রাজধানীর ‘শাপলা’ চত্বরে জমায়েত হওয়ার পর হেফাজতে ইসলাম প্রথম দেশব্যাপী নজর কাড়ে। জানা যায়, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মাদ্রাসায় আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠিত হয়। আমির মনোনীত হন শাহ আহমদ শফী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। জানা যায়, হেফাজতের আমির হিসেবে তিনজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। এরা হলেন বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এবং হেফাজতের ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী।

জানা যায়, হেফাজতের আমির যিনি হবেন তিনিই হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম থাকবেন- এমনটাই মনে করছেন অনেকে। তাই হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক থেকে পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই হেফাজতে ইসলামের হাল কে ধরবেন সে প্রশ্নটাও সামনে আসে। তবে মাদ্রাসার যিনি প্রধান হবেন তিনিই হেফাজতে ইসলামের আমির হবেন এমন কোনো বিধান নেই।

এ প্রসঙ্গে সংগঠনের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী জানান, হুজুরের (আল্লামা শফী) জানাজা-দাফন শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বৈঠক করেছি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুত হেফাজতে ইসলামের সম্মেলনের ডাক দেব।

এদিকে আল্লামা শফীর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা সদস্যরা বৈঠকে বসেন। বৈঠকে পাঁচজন শূরা সদস্যকে নতুন করে নিয়োগ ছাড়াও মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। শিক্ষা সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে। এতে করে মাদ্রাসায় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মনে করা হচ্ছে। মাদ্রাসা পরিচালনায় কিছু পরিবর্তন এনেছেন শূরা সদস্যরা। ধারণা করা হচ্ছে, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা চাইবেন দ্রুততার সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম, বেফাকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিতে। তবে আল্লামা শফীর দীর্ঘদিনের বলয়ে ফাটল ধরাতে কষ্টকর হবে বাবুনগরী ও তার অনুসারীদের। কওমি সমাজে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

এদিকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং সরকার স্বীকৃত সম্মিলিত বোর্ড আল-হাইআতুল উলুয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার প্রধান হিসেবে আলোচনায় আসছেন বেফাকের সহসভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী ও নুরুল ইসলাম, ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসানসহ আরও কয়েকজন।

প্রচলিত রীতি অনুযায়ী কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রধানই আল-হাইআতুল উলুয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হন। তিনি ২০১৭ সালে সরকার স্বীকৃত সম্মিলিত বোর্ড আল-হাইআতুল উলুয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যানও নিযুক্ত হন। সরকার স্বীকৃত এই সম্মিলিত বোর্ডের অধীনে রয়েছে আরও পাঁচটি বোর্ড। এগুলোর একটি হচ্ছে চট্টগ্রামভিত্তিক আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসিল কওমিয়া চট্টগ্রাম। এই ছয় বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত সব দাওরায়ে হাদিস কওমি মাদ্রাসা সম্মিলিত বোর্ড আল-হাইআতুল উলুয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়ার অধীনে পরীক্ষা দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও বেফাকের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক জানান, হুজুরের (আল্লামা শফী) জায়গা পূরণ হওয়ার নয়। তারপরও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তার সব শূন্য পদ পূরণ করা হবে।

দুই নেতার অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ : হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যু এবং দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বিতর্ক থামছে না। সদ্য প্রয়াত হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা পাল্টাপাল্টি মামলা দায়েরের হুমকি দিচ্ছেন।

আল্লামা আহমদ শফী অনুসারী হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘পরিকল্পিত আন্দোলনের নামে মাদ্রাসায় অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আল্লামা আহমদ শফীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে আল্লামা শফীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। ফলে তিনি মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছেন।’

এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি আল্লামা বাবুনগরীর অনুসারীরা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী এক নেতা বলেন, ‘হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আন্দোলনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। ওই আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফসল। আন্দোলনের মধ্যে আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যু ছিল অনাকাক্সিক্ষত। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’

জানা যায়, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আহমেদ দিদার কাসেমীর একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ওই ডিভিওতে সার্বিক পরিস্থিতির জন্য আল্লামা বাবুনগরীকে দায়ী করেন তিনি। যদিও পরে সেই ভিডিও প্রত্যাহার করে নেন তিনি। এ ছাড়া হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আন্দোলন, আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যু এবং জানাজার নামাজ বিতর্কে সক্রিয় রয়েছেন আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীরা। তাদের এ দাবির পাল্টা অবস্থান নিয়েছেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা। তাদের দাবি, হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল আনাস মাদানী ও তার অনুসারীদের প্রতি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা এবং হয়রানির ফসল। জনপ্রিয় কিছু শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত মেনে নেননি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাই এসবের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন তারা। এর সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলেন না বাবুনগরী বা তার অনুসারীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর