শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

তবু থামেনি সড়কে নৈরাজ্য

বাসের প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে প্রাণ, কেউ মানছে না গতিসীমা, লেন দখলে ফাঁকা সড়কেও যানজট, ঠোকাঠুকিতে সড়কজুড়ে ভাঙা কাচ, আগস্টেই সড়কে ঝরেছে ৪৫৯ প্রাণ

গোলাম রাব্বানী ও শামীম আহমেদ

তবু থামেনি সড়কে নৈরাজ্য

স্পটে ৩-৪ জন ট্রাফিক সার্জেন্ট ডিউটি পালন করেন। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। গতকাল দুপুরে রাজধানীর নতুনবাজার এলাকা থেকে তোলা ছবি -রোহেত রাজীব

২৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা ২৭ মিনিট। অফিসটাইম না হওয়ায় রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাঁকা। তার পরও খিলক্ষেত ওভারপাসের নিচের এয়ারপোর্টমুখী সড়কটি যানজটে বন্ধ। সড়কের সবকটি লেন দখল করে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ১২-১৩টি বাস। হঠাৎ দুই বাসের মধ্যে ঘর্ষণে সড়কে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। এর মধ্যে ডান লেনে সামান্য ফাঁকা জায়গা পেয়েই গতি বাড়িয়ে শাঁ শাঁ করে বেরিয়ে যায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা ডজনখানেক প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান ও মোটরসাইকেল। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ফের বন্ধ হয়ে যায় সবকটি লেন। ব্যস্ততম সড়কটির বাকি অংশ ফাঁকা থাকলেও ওই স্থানটির পেছনে ২০০ গজের মধ্যে যানজটে আটকে ছিল অর্ধশত গাড়ি। শুধু খিলক্ষেত বাস স্টপেজ নয়, এমন নৈরাজ্যের চিত্র রাজধানীর প্রতিটি সড়ক ও স্টপেজের। এতে শুধু যানজটই বাড়ছে না, মুহূর্তে বলি হচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ। কেউ সারা জীবনের জন্য হচ্ছে পঙ্গু। দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কেও চলছে গণপরিবহনের এমন উগ্র প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত চার মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। আহত হয়েছে আরও বেশি। সাজা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস ও দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানেও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। থামেনি মৃত্যুর মিছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন সড়কে যানবাহন চলা বন্ধ থাকার পর ১ জুন ফের চালু হয়। এরপর পরিবহন মালিক ও চালকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে বেড়েছে দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু গত আগস্টেই দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৮৮টি দুর্ঘটনায় ৪৫৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬১৮ জন। যানজটের কারণে রাজধানীতে যানবাহনের গতি কম থাকলেও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ১৫ শতাংশই ঘটেছে ঢাকা মহানগরীতে। এ ছাড়া ৪৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ দুর্ঘটনা আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ১৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা গেছে, গত মের তুলনায় জুনে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যায়। মে-তে সারা দেশে ২১৩ দুর্ঘটনায় ২৯২ জন নিহত হয়। জুনে ২৯৭ দুর্ঘটনায় ৩৬১ জন নিহত ও ৩৪৮ জন আহত হয়। জুলাইয়ে ২৯৩ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৩৫৬ জন। আহত হয় ৩৪১ জন। শুধু ঈদুল আজহার আগে ও পরে ১৪ দিনে ১৮৭ দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২২৯ জন, আহত ৩১৮ জন। আহতদের অনেকেই এখনো হাসপাতালের বিছানায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। অনেকেই আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। আগস্টের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট দুর্ঘটনার ৫২ দশমিক ৮৩ শতাংশ গাড়িচাপা, ২৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ খাদে পড়ে, বাকি ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ অন্যান্য কারণে। রাজধানীর খিলক্ষেত বাস স্টপেজে ভিডিওচিত্র ধারণ করে দেখা যায়, মাত্র ৩৩ সেকেন্ডে ওই পয়েন্টে এসে দাঁড়ায় ও পেরিয়ে যায় প্রায় ৪৫টি ছোট-বড় গাড়ি। বাঁ লেনে বাস থামার জায়গা থাকলেও সড়কের সবকটি লেনই দখলে ছিল বাসের। এ সময়ের মধ্যে রাস্তার বিভিন্ন লেন দখল করে যাত্রী তুলতে দেখা যায় একটি স্কাইলাইন (বাঁ লেনে), দুটি ভিক্টর ক্ল্যাসিক (একটি মাঝ লেনে, অন্যটি দুই লেনের মাঝে), দুটি বলাকা (একটি ডান লেন থেকে হঠাৎ বাঁ লেনে, অন্যটি বাঁ লেনে), একটি আজমেরী গ্লোরী (বাঁ লেনে), একটি প্রভাতী বনশ্রী (মাঝ লেনে), আরেকটি ভিক্টর ক্ল্যাসিক (ডান লেন দিয়ে এসে শাঁ করে ঢুকে পড়ে বাঁ লেনে) পরিবহনের বাসকে। এর মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ডান লেন ফাঁকা পেয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় আলম এশিয়া, সৌখিন এক্সপ্রেসসহ কয়েকটি দূরপাল্লার বাস, ৭-৮টি মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা ও বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ খিলক্ষেত থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সড়কের বাকি অংশে তখন ছিল না কোনো যানজট। এ সড়কেরই লা মেরিডিয়ান হোটেলের সামনে ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপনডেন্ট ইকরাম-উদ দৌলার মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় তুরাগ পরিবহনের একটি বাস। বাসটি তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষলেও ততক্ষণে ইকরামের পাঁজরের ৮টি হাড় ভেঙে যায়। বাসের চাকা আর একটিবার ঘুরলেই পিচের রাস্তায় পিষে যেতেন ইকরাম। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রাণে বেঁচে গেলেও কতটুকু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান চিকিৎসকরা। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে এমন অসংখ্য মানুষ।

এ ব্যাপারে বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও এনা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একই কোম্পানির গাড়ি রাস্তায় প্রতিযোগিতা করছে। কোম্পানির নাম একটা, গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন মালিকের। কিছু গাড়ি আছে চুক্তিভিত্তিক চলে। এগুলোই বেশি প্রতিযোগিতা করে। আমরা এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। বর্তমানে রাজধানীতে ৩০ শতাংশ গাড়ি চুক্তিভিত্তিক চলছে। আগে ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রতিযোগিতা কমাতে পার্কিং বে নির্মাণ ও সব কোম্পানির গাড়ির কাউন্টার করে দিতে হবে। বাস রুট রেশনালাইজেশন হলে স্থায়ী সমাধান হবে। এক কোম্পানির অধীন সব গাড়ি আসবে। আলাদা ব্যক্তিমালিকানায় গাড়ি থাকবে না। সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বসে এ বিষয়টা আমরা বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছি।’

গতকাল সরেজমিন রাজধানীর নর্দা, নতুন বাজার, শাহজাদপুর, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, রামপুরা ব্রিজ, মিরপুর-১ ও ১০ নম্বর ঘুরে প্রতিটি বাস স্টপেজে দেখা যায় গণপরিবহনের প্রতিযোগিতা। এর আগের দিন বুধবার বেলা ৩টায় কয়েকটি বাসের খামখেয়ালিপনায় মিরপুর-১০-এর ব্যস্ততম গোলচত্বরে থমকে যায় যান চলা। আগারগাঁও যাওয়ার রাস্তার মুখ দখল করে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় নামে শিকড় পরিবহন (ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৪৮৩৬), হিমাচল পরিবহন ও আরেকটি কোম্পানির একটি বাস। পেছনে অসংখ্য ছোট-বড় গাড়ি আটকে পড়ায় মুহূর্তে হর্নের শব্দে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার বাতাস। তখন সিগন্যাল বন্ধ থাকলেও ডানের সড়কে ঢোকার চেষ্টা করছিল রাজধানী পরিবহনের একটি বাস। এ সময় মিরপুর গোলচত্বরের চারদিকের ৮টি লেনেই সৃষ্টি হয় গাড়ির ভয়াবহ জটলা। যাত্রীদের অভিযোগ, কিছু গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে লোক তুললেও অধিকাংশ গাড়িই খেয়ালখুশিমতো রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করে। দ্রুত নামাতে গিয়ে অনেক সময় যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বাসের হেলপার। অনেক যাত্রী পা সামলাতে না পেরে পড়ে যায় মাঝ রাস্তায়।

কেউ মানছে না গতিসীমা : এদিকে রাজধানীর অধিকাংশ সড়কে নেই কোনো গতিসীমা নির্ধারক চিহ্ন। হাতিরঝিল এলাকা, ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়েসহ অল্প কিছু সড়কে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও কেউ মানছে না তা। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের খিলক্ষেত থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বাঁ লেন বাদে অন্য তিন লেনে গতিসীমা দেওয়া রয়েছে যথাক্রমে ঘণ্টায় ৪০/৫০/৬০ কিলোমিটার। অথচ এ সড়কটিতে অধিকাংশ গাড়ির গতিবেগ থাকে ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এমনকি সবচেয়ে কম গতির লেন দিয়ে দ্বিগুণ গতিতে ওভারটেকিং করতে দেখা যায় বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারকে। এ ছাড়া সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দূরপাল্লার যাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে অধিকাংশ যাত্রী মহাসড়কে বাসের গতি নিয়ে অভিযোগ করেন। বাসগুলো দিনের চেয়ে রাতের বেলা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে বলে জানান তারা। অনেক ক্ষেত্রে গতি কমাতে বললে বাসচালক আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, এমনকি যাত্রীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে জানান তারা।

ঠোকাঠুকিতে সড়কজুড়ে ভাঙা কাচ : যাত্রী তোলা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে রাজধানীর প্রতিটি স্টপেজে একাধিক বাসের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে। প্রতিটি বাসের গায়েই সংঘর্ষের চিহ্ন। নেই জানালার কাচ। সংঘর্ষের কারণে প্রায়ই গাড়ির কাচ ভেঙে আহত হয় যাত্রী। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে অধিকাংশ স্টপেজের সড়কেই পড়ে থাকতে দেখা গেছে গাড়ির কাচের ভাঙা টুকরো।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর