সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা বেপরোয়া ধর্ষণে

জিন্নাতুন নূর

হঠাৎ করে ব্যাপক হারে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে নাগরিক সমাজে। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মহামারীর এই সময়ে বেপরোয়া ধর্ষণের কারণ হচ্ছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস সর্বোচ্চ বেড়ে যাওয়ার কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া অবস্থান নিয়েছে। এখনই ধর্ষকদের প্রতিরোধের সময়। এ নিয়ে গতকাল সারা দেশে ধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে। গত কয়েক দিনে দেশের খাগড়াছড়ি, সাভার, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিষ্ঠুর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও অভিযুক্ত ধর্ষকদের আটক করেছে। সারা দেশে হঠাৎ করে ধর্ষকদের এই বেপরোয়া আচরণের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, দুর্বল ব্যক্তিত্ব ও হতাশাগ্রস্ত মানুষ এবং ক্ষমতার কারণে অহংকারী ব্যক্তিরা ধর্ষণের মতো অপকর্ম করছে। তারা বলেন, সমাজে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতাও উসকে দিচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। আবার মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকার কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে মনোরোগ চিকিৎসক অধ্যাপক মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা সংঘবদ্ধ হয়ে ধর্ষণ করে, তাদের মধ্যে শক্তি ও আধিপত্যের উৎস থাকে। এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক তাড়নার কারণে ধর্ষকরা এমন কাজ করে। সবার মধ্যেই জৈবিক প্রবৃত্তি আছে। সেই প্রবৃত্তিকে আমাদের বিবেক নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যখনই কেউ ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যাবে, তখনই বিবেকবোধ মরে যাবে। তখন সে মানুষটি কী করছেন তা বুঝতে পারবেন না। যারা এই ঘৃণ্য কাজ করবেন, তাদের মনে হবে তারা উল্লাস করছেন। কিন্তু এটি এক ধরনের পশুবৃত্তি। আর এ ধরনের বৃত্তি সেই মানুষদের মধ্যেই জেগে ওঠে, যারা নিজের বিবেকের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ধর্ষককে সর্বোচ্চ বিচারের আওতায় নিয়ে যেতে হবে। এমনকি ঘটনায় অভিযুক্ত আসামির ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। প্রকৃত ধর্ষককে যদি ঘটনার পর পর গ্রেফতার করা যায়, তবে আগেই তার সামাজিক বিচার হতে হবে। যারা এই অপকর্ম করে, তারা যখন কাজটি করে, তখন একটিবারের জন্যও ভুক্তভোগী মেয়েটির জীবনের কথা ভাবে না। ধর্ষণ যে একটি সামাজিক ও অমানবিক অপরাধ, এই মনোভাব তরুণ সমাজের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটগুলো ধর্ষণের মতো অপরাধ উসকে দিচ্ছে। এই সাইটগুলো মানুষের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ এবং বিবেকবোধ শেষ করে দিচ্ছে। আর যারা পর্নোগ্রাফির জগতে ঢোকে, তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কমে যায়। এতে ধর্ষকরা নারী দেখামাত্রই তাকে ‘ভোগ্যপণ্য’ মনে করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, ‘মহামারীর কারণে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে। এতে এসব শিক্ষার্থী আগের তুলনায় বাড়তি সময় পাচ্ছে। আর এই বাড়তি সময়টাকে অনেকে ভালো কাজে লাগাতে পারছে না। ফলে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। আবার আমাদের গ্রামাঞ্চলে সামাজিকীকরণ ব্যবস্থা এখনো ততটা কঠোর নয়। ফলে অভিভাবকদের জন্য উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রযুক্তির এই যুগে নজরদারি করাও বেশ কঠিন। এখন সন্তানরা চাইলেই অভিভাবকদের কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে, যা আগে তারা পারত না। সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধগুলো বেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের জন্য যদি অপরাধীকে দ্রুত কঠোর শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো ঘৃণ্য এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু দেশে ধর্ষণ মামলাগুলোতে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হয়। আবার ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোর কথা মানুষ দ্রুতই ভুলে যায়। যারা ধর্ষণ করছে, অপরাধ ঘটানোর পর যদি তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়, তবে ধর্ষণের ঘটনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, করোনার মহামারীতে চলাচলের শিথিলতার কারণে অনেক ধর্ষণ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। মহামারীতে জবাবদিহি কম থাকায় ধর্ষণের মতো অপরাধগুলোও বেড়ে যাচ্ছে। ধর্ষকরা দেশে প্রচলিত ধর্ষণ অপরাধ-সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। যত দিন মানুষ জবাবদিহির মধ্যে থাকবে না, তাদের মূল্যবোধের অভাব থাকবে। নারীকে যত দিন মানুষ বলে গণ্য করা হবে না, ততদিন ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ধর্ষকদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে দেখা যাবে, তারা অনেক অপরাধ করে তবেই এই ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস পায়। ধর্ষণ শুধু সরকারের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সমাজের সবারই এ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় বলেন, বাংলাদেশের ধর্ষকরা অপকর্মটি করে পার পেয়ে যাওয়ায় ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আবার ক্ষমতাশালীরা তাদের ক্ষমতার বেপরোয়া ব্যবহার করছে, যা এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর বাইরে দেশে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ধর্ষকদের এ কাজে উদ্দীপ্ত করছে। একজন মানুষ যদি অনবরত পর্নো দেখে, তখন তার মনে এই বিষয়গুলোই ঘুরে বেড়ায়। তখন মেয়েদের নিয়ে এসব মানুষ এক ধরনের অবাস্তব সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেড হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে সেই চিন্তাই প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। আর এই সাইকোলজিক্যাল আবহ তখন সেই মানুষদের ধর্ষণে উসকে দেয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর