শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা
এনআইডি জালিয়াতি

ধরাছোঁয়ার বাইরে গডফাদাররা

এনআইডি কার্যক্রম ঝুঁকিতে ফেলছে ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা, ৮ বছরে চাকরিচ্যুত ৩৯ জন

গোলাম রাব্বানী

নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কার্যক্রম হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা। জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি, সংশোধন, দ্বৈত ও রোহিঙ্গাদের ভোটার করার সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন তারা। এসব কাজে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকাও লেনদেন হচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে সংশোধিত এনআইডি দিয়ে জাল দলিল, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা একাই জালিয়াতির কাজ করছেন না। তাদের নেপথ্যে রয়েছেন বড় কোনো গডফাদার। তবে এনআইডি জালিয়াতির তদন্ত হলেও গডফাদার ও বড় বড় কর্মকর্তা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। উপজেলা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এনআইডির বিভিন্ন সংশোধনীর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তদবির, ইসি ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কর্মকর্তার তদবির থাকে। এ ছাড়া ভোটাররা বয়স পরিবর্তন, নাম পরিবর্তনের অযৌক্তিক আবেদন করেন। সব সংশোধনী সম্ভব হয় না। তখন ভোটাররাও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, ইসির কর্মকর্তাদের পিয়ন, সহকারী ও দালালের মাধ্যমে এসব কাজ করেন। অনেক সময় দেখা যায় উপজেলা অফিসকে পাশ কাটিয়ে বড় বড় সংশোধনী হয়। এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা ইসি সচিবালয় চাইলেই বের করতে পারে। তাই দিন দিন জালিয়াতির ঘটনাও বাড়ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মূলত আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত জনবল জালিয়াতির সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন। কারণ তাদের কোনো দায় নেই। তারা নিয়োগ পাওয়ার জন্য নিয়োগ দানকারী প্রতিষ্ঠানকে লাখ লাখ টাকা দিচ্ছেন। আবার তাদের বেতনের কিছু অংশ পাচ্ছেন নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান ও ইসির কিছু অসাধু কর্তা। ফলে তারা দুই হাতে টাকা কামানোর ধান্দায় নেমেছেন। তারা বলছেন, এনআইডির মতো স্পর্শকাতর বিষয় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা লোক দিয়ে চলতে পারে না। এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্ট কার্ডের অনেক কাজ আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা লোক দিয়ে চলছে। ভবিষ্যতে এমন চলতে থাকলে এনআইডি কার্যক্রম হুমকিতে পড়বে।

জালিয়াতি-সংক্রান্ত এক ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘অনৈতিক কাজ করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। নির্বাচন কমিশন বা এনআইডি উইংয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হোক এটা আমরা কিছুতেই চাই না। জালিয়াত চক্রে জড়িতদের শনাক্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া এনআইডি জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত ইসির অস্থায়ী কর্মী ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের বিরুদ্ধে মামলা ও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ইতিমধ্যে দেশব্যাপী এনআইডি সেবা কার্যক্রম তদারকিতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ১০টি টিমের মাধ্যমে সাঁড়াশি ও ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হবে। ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক তথ্যসহ আলাদা রোহিঙ্গা ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে। ভোটার তালিকায় অবৈধভাবে রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি অনুসন্ধানে টিম পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তে একটি কারিগরি এবং একটি প্রশাসনিক কমিটি গঠন করা হয়।

এনআইডি উইং ডিজি বলেন, ‘২০১১ সালে হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ কে কে ব্যবহার করেছেন, কীভাবে তা ব্যবহৃত হয়েছে, ঘরে-বাইরে কারা সম্পৃক্ত ছিলেন এ জালিয়াতিতে- প্রতিটি বিষয় আমরা এনালাইসিস করছি। এখন তদন্ত কমিটি দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সাময়িক বহিষ্কারের পর মামলাও হবে : এনআইডি উইং মহাপরিচালক জানান, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত এসব লোকবল অনিয়মে জড়িত হলে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু এর পরও অনেকে কৌশলে জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত আট বছরে ৩৯ জনকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে তাদের করা হয় কালো তালিকাভুক্ত।

লাখো দ্বৈত ভোটারের বিষয়ে তৎপরতা : ১১ কোটি ভোটার তালিকাভুক্তির সময় হালনাগাদে দুই লাখের মতো দ্বৈত ভোটার শনাক্ত করে নির্বাচন কমিশন। তাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এনআইডি উইং মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে দুই লাখ সাত হাজার দ্বৈত ভোটার হওয়ার চেষ্টাকারীদের শনাক্ত করেছি। যারা দ্বৈত হয়েছেন আমরা তাদের নোটিফাইড করছি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্য গোপন করে দ্বৈত ভোটার হওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ইতিমধ্যে ৯৩৭ জনের এনআইডি লক করাসহ ?আইন অনুসারে নির্বাচন কমিশন ফৌজদারি মামলা দায়ের করার নির্দেশনা দিয়েছে।’

লিখিত অভিযোগ চায় ইসি : কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত না হতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ নির্দেশনা-সংক্রান্ত আইডিইএ প্রকল্পের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান খানের সই করা একটি চিঠি সম্প্রতি ইসির মাঠ প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি কতিপয় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করছে। দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট এনআইডি কার্ড তৈরির কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকার সবুজবাগ ও গুলশান থানা নির্বাচন কার্যালয়ে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের মাদকদ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অবৈধ রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনজন ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর যে-কেউ যে কোনো ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ ও প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া যদি কেউ জালিয়াতি ও দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য ও প্রমাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করতে পারে, তবে তাকে যথাযথ পুরস্কার প্রদান করা হবে। আইডিইএ প্রকল্পের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানোর জন্য ইসির মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর