রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কষ্টের শেষ নেই ইউরোপের জঙ্গলে

অবৈধ পথে স্বপ্নের হাতছানিতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, ধরা পড়ে হচ্ছে জেল

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

কষ্টের শেষ নেই ইউরোপের জঙ্গলে

অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের দুর্বিষহ জীবনযাপন -এএফপি

ইউরোপে গিয়ে জীবন পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে এখন জঙ্গলে মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। পূর্ব ইউরোপের ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে বসনিয়ার জঙ্গলের এ অমানবিক ঘটনা উঠে আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয়। দারিদ্র্যপীড়িত বসনিয়াকে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থী এড়িয়ে চলছিলেন এত দিন। কিন্তু সম্প্রতি বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের এ পথটি ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। বসনিয়ার পাশাপাশি স্লোভেনিয়া সীমান্ত দিয়েও অনেকে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশ করছেন। অবশ্য তার বেশির ভাগেরই মূল গন্তব্য ইতালি। জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, বসনিয়া সরকার দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরের উদ্বাস্তুদের ক্যাম্প ভেঙে দিলে অন্যান্য দেশ থেকে আসা মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশিরাও বিপৎসংকুল যাত্রা করেন। দল বেঁধে তারা সীমান্তবর্তী একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেন। জঙ্গলে গাছের নিচে তাঁবু গেড়ে আপাতত রাত কাটাচ্ছেন। তীব্র শীতে রাত কাটানোর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকায় অসহায় সবাই। পানির অভাবেও ভুগছেন তারা। বালতি দিয়ে নদী থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে কয়েকজনকে। লম্বা বিপৎসংকুল পথে যাত্রার জন্য যে মানসিক শক্তি প্রয়োজন তা ইতিমধ্যে হারিয়েছেন অনেকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের এ যাত্রাকে তারা বলছেন ‘গেম চেঞ্জিং’ মিশন। মিশন সফল হবে কিনা জানেন না তারা। কষ্ট আর অনিশ্চয়তায় ক্লান্ত অনেকেই।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় যাওয়ার জন্য ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার একটি বনের মধ্যে যে কয়েক শ অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন তারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মরক্কো ও আলজেরিয়ার নাগরিক। গত বুধবার সকালে ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের কাছে জঙ্গলে ওই অভিবাসনপ্রত্যাশীর দলটির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রচ- ঠান্ডার মধ্যে পরিত্যক্ত একটি কারখানা ভবন এবং কার্ডবোড, গাছের ডাল ও পলিথিন দিয়ে বানানো তাঁবুতে আছেন তারা। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে তারা তাঁবুর আশপাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে থাকা বাংলাদেশি মোহাম্মদ আবুল রয়টার্সকে বলেন, ‘এখানে সমস্যা অনেক। থাকার ঘর নেই, পানি নেই, টয়লেট নেই, কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই।’

রয়টার্স জানিয়েছে, তিন দশক আগে যুদ্ধের পর অভিবাসীদের স্বাগতই জানাচ্ছিল বসনিয়া। জাতিগতভাবে বিভক্ত বসনিয়ার সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার নেতৃত্বাধীন অঞ্চল বরাবরই অভিবাসী অভ্যর্থনায় অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। ফলে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বসনিয়ার সারাজেভো ও ক্রাজিনা সীমান্তে আশ্রয় নেওয়ার দিকেই ঝুঁকেছেন। কিন্তু সম্প্রতি বসনিয়া অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার নীতিতে কঠোর হয়েছে। এখন অভিবাসীদের বোঝা মনে করছে। অন্যদিকে ইইউ তাদের অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা আরও কঠোর করছে বলে তাড়াহুড়া করে ঢুকতে চাইছেন অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। অনেকেই রাবার নৌকায় করে ড্রিনিয়া নদী ধরে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন এবং খরস্রোতা নদীতে ডুবে যাওয়ার ঘটনাও অনেক। তবু তারা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন ইউরোপে প্রবেশের।

অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার রাস্তা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। সাগরে মৃত্যুর পাশাপাশি ইইউর কড়া পাহারায় ইতালিতে ভেড়া যাচ্ছে না। ফলে ইতালি যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশিরা বসনিয়া ও স্লোভেনিয়ার রাস্তা ব্যবহার করছেন।

তাই ইউরোপে মানব পাচারের অন্যতম রুট এখন বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া বা স্লোভেনিয়া-ক্রোয়েশিয়া। বসনিয়া-স্লোভেনিয়ার সীমান্তগুলোয় বাড়ছিল অভিবাসনপ্রত্যাশীর ভিড়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) গত এপ্রিল থেকে বসনিয়ায় অভিবাসীদের জন্য অন্তত সাতটি শিবির পরিচালনা করে আসছিল। বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ শিবিরগুলো উঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে দুই সপ্তাহ ধরে ওইসব শিবিরের লোকজন ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার বনজঙ্গল ও পরিত্যক্ত ভবনে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে সড়কের ধারে ছাপড়া তুলে অবস্থান নিয়েছেন।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, বসনিয়ার পাশাপাশি স্লোভেনিয়াও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিষয়ে কঠোর হয়ে উঠেছে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের ইলিরস্কা বিস্ত্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত রবিবার মোট ১৪৪ জনকে আটক করা হয়েছে। আটক অভিবাসীর অধিকাংশই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। গত মঙ্গলবার ওরমজ এলাকায় পুলিশ একটি ভ্যান থেকে ২২ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আটক করে। তার ১১ ছিলেন বাংলাদেশি। ইলিরস্কা বিস্ত্রিকা শহরের মেয়র ইমিল রোচ গণমাধ্যমকে জানান, গত কয়েক সপ্তাহে অবৈধ অভিবাসী আটকের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে স্লোভেনিয়ায় অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপরাধে ১০ হাজার ২২৩ জন অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর ও স্থলসীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানো ব্যক্তিদের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে মারাও গেছেন বড়সংখ্যক বাংলাদেশি। এ রুটে ২০১৯ সালে মারা গেছেন ১ হাজার ৩১৯ জন, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১৩৯ জন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ২৭৭ জন, ২০১৬ সালে ৫ হাজার ৯৬ জন এবং ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৭৭১ জন। আর চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ভূমধ্যসাগর আর স্থলপথে ইউরোপে পৌঁছেছেন ৩ হাজার ৩২৫ জন বাংলাদেশি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর