রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

তৃণমূলের কমিটিতে মাইম্যান রাখায় ক্ষুব্ধ শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

তৃণমূলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে অনেক স্থানে ‘মাইম্যান’ ও অনুপ্রবেশকারীদের স্থান দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় দফতরে জমা পড়া ২৫-২৮টি কমিটির মধ্যে যেগুলোয় অভিযোগ পড়েছে সেগুলো পুনরায় যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গতকাল সকালে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, তৃণমূলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দলের দুর্দিন-দুঃসময়ের ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতাদের ঠাঁই দিতে হবে। কোনো নেতা বা এমপির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কমিটি গঠন করা যাবে না। ছাত্রদল-যুবদল, শিবির, ফ্রীডম পার্টি করা লোকজন আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকবে আর আমার দলের জন্য যারা ঝুঁকি নিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারা জায়গা পাবেন না- তা হবে না। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে সীমিত পরিসরে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের ৩২ জন নেতা এতে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমেই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দেন। পরে ৩ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। বৈঠকে ছয় সাংগঠনিক সম্পাদক নিজ নিজ বিভাগের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। বৈঠকসূত্র জানান, সূচনা বক্তব্য শেষে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি ফাইল খুলে কোন জেলায় শিবির, ছাত্রদল-যুবদল, ফ্রীডম পার্টির নেতা জায়গা পেয়েছেন, কোথায় ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীকে উপেক্ষা করা হয়েছে সেগুলো তুলে ধরেন। এ সময় অনুপ্রবেশকারী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও বিতর্কিতরা স্থান পাওয়ায় নতুনভাবে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন তিনি। এজন্য আট বিভাগে আওয়ামী লীগের আটটি সাংগঠনিক টিম গঠন হয়। এ টিমগুলো এখন থেকে বিভাগের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধান করবে। সভায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে শিগগিরই ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সূত্রগুলো জানান, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সভার শুরুর দিকেই রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, গাজীপুর, নরসিংদীসহ বেশ কয়েকটি জেলার প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। এসব জেলায় আওয়ামী লীগের পুরনো নেতাদের বাদ দিয়ে কোথাও জামায়াত-বিএনপির সাবেক নেতাদের স্থান দেওয়া, কোথাও দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা ২৫-২৮টির মতো জেলা ও মহানগর কমিটি ফেরত দিয়ে সেগুলো থেকে অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে নতুনভাবে কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ‘নেত্রী যে কমিটিগুলো ফেরত দিয়েছেন সেগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বসে পুরনো নেতা-কর্মীদের নিয়ে নতুনভাবে কমিটি করবেন। দরকার হলে কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে বসবেন।’ সূত্রগুলো জানান, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে কথা বলেন দলটির কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের প্রস্তাবিত কমিটিতে সহসভাপতি, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বেশকিছু সম্পাদকীয় পদে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে তারা অনেকেই ঢাকার ভোটার নন। ভোটের সময় তাদের পাওয়া যায় না। নিজ নিজ এলাকায় চলে যান। এতে ভোটের সময় সংকট সৃষ্টি হয়। কমিটিতে ঢাকার ভোটারদের প্রাধান্য দেওয়ার পরামর্শ দেন সাঈদ খোকন। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, স্থানীয় ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। বৈঠকে গাজীপুর মহানগর কমিটি গঠনে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের নির্বাচনী এলাকার ৩৫টি ওয়ার্ড থাকলেও তার মতামত নেওয়া হয়নি বলে আলোচনা হয়। মহানগর এলাকার বেশির ভাগ রাসেলের নির্বাচনী এলাকায় হলেও তাকে জিজ্ঞেস না করেই কমিটি গঠিত হয়। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গাজীপুর মহানগর নেতাদের জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে বসে সমন্বয় করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ঢাকা হলো সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল বিভাগ। বিশেষ করে ঢাকা শহরে বেশি সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের ২৪টি থানা ও ৭৫টি ওয়ার্ডে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এখানে সাড়ে চার বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি। আগামীতে কমিটি করতে হলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে যেন জেলা-উপজেলা ওয়ার্ড কমিটি করা হয় সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে তৃণমূলে কোনো কমিটি গঠন যেন না হয় সেদিকেও গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। এ সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের জেলা, মহানগর, উপজেলাসহ অন্যান্য কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমেই গঠনের নির্দেশ দেন। বৈঠকে ঢাকা মহানগরীতে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠন না হওয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের বিগত কমিটির নেতাদের বারবার ডাকলেও তারা সাড়া দেননি। সে কারণে প্রতিটি থানায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনা বলেন, সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে কে কোথায় কী

সমস্যা ফেস করছেন, তা আমাকে অবহিত করবেন। আমি চাই তৃণমূলে দলের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা-কর্মীসহ সমাজে যারা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ আছেন তাদেরও দলে টানতে হবে। তোমরা কাজ করতে গিয়ে কমিটি করতে গিয়ে কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে তা আমাকে জানাবে। দলে সেক্রেটারি আছে তাকে জানাবে।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অংশগ্রহণে আওয়ামী লীগের একাধিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার তথ্য তুলে ধরেন। মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি বর্তমান বাস্তবতায় নারীদের কল্যাণে কর্মসূচি গ্রহণের প্রস্তাব রাখেন। মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমাদের সরকার করোনাকালে অনেক মানবিক কাজ হাতে নিয়েছে। এতে দেশবাসী প্রশংসা করছে। তবে করোনাকালে বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। আপনি (প্রধানমন্ত্রী) নিজেই কমিটি গঠন করে দিন, এতে আইনজীবী, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, আমাদের দলীয় লোকজন থাকবেন। যাদের কাজ হবে বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা। যখনই এসব ঘটতে যাবে তখনই কমিটির লোকজন প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। প্রয়োজনে আইনের সহায়তা নেবেন। আট বিভাগে সাংগঠনিক টিমে আছেন যারা : আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে আটটি সাংগঠনিক বিভাগের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত টিম অনুমোদন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এ সিদ্ধান্ত দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। এরপর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর সরকারি বাসভবনে প্রেস বিফ্রিংয়ে এসব টিমের তালিকা প্রকাশ করেন।

রংপুর বিভাগ : টিম সমন্বয়ক হিসেবে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দায়িত্ব পালন করবেন। এ বিভাগের দায়িত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে রয়েছেন রমেশ চন্দ্র সেন ও শাজাহান খান। এ ছাড়া এইচ এন আশিকুর রহমান, হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া ও সফুরা বেগম থাকছেন এ টিমে। রাজশাহী বিভাগ : টিম সমন্বয়ক হিসেবে থাকছেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। এ বিভাগের সমন্বয়ের দায়িত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে রয়েছেন আবদুর রহমান। বাকি সদস্যরা হলেন ডা. রোকেয়া সুলতানা, নুরুল ইসলাম ঠান্ডু, মেরিনা জাহান ও বেগম আখতার জাহান। খুলনা বিভাগ : খুলনা বিভাগে টিম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে থাকছেন কাজী জাফরউল্যাহ ও পীযূষকান্তি ভট্টাচার্য। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন হাবিবুর রহমান সিরাজ, আমিরুল ইসলাম মিলন, পারভিন জামান কল্পনা ও গ্লোরিয়া সরকার ঝর্ণা। সিলেট বিভাগ : সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক। এ টিমে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে থাকছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক ও নুরুল ইসলাম নাহিদ। বাকি সদস্যরা হলেন ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী ও সায়েম খান। ময়মনসিংহ বিভাগ : টিম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। এ টিমে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে থাকছেন মতিয়া চৌধুরী। বাকি সদস্যরা হলেন অসীম কুমার উকিল, মারুফা আক্তার পপি ও উপাধ্যক্ষ রেমন্ড আরেং। চট্টগ্রাম বিভাগ : টিম সমন্বয়ক হিসেবে থাকছেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। এ টিমে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে থাকছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও আবদুল মতিন খসরু। টিমের বাকি সদস্যরা হলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ওয়াসিকা আয়েশা খান, ফরিদুন্নাহার লাইলী, ড. সেলিম মাহমুদ, সুজিত রায় নন্দী, ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুর, হারুনুর রশীদ, আমিনুল ইসলাম আমিন ও দীপংকর তালুকদার। বরিশাল বিভাগ : বরিশাল বিভাগের টিম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন। টিমের বাকি সদস্যরা হলেন আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন, গোলাম কবির রাব্বানী চিনু ও আনিসুর রহমান। ঢাকা বিভাগ : ঢাকা বিভাগে টিম সমন্বয় হিসেবে থাকছেন যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। এ টিমে প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে থাকছেন ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান ও অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান। বাকি সদস্যরা হলেন আবদুস সোবহান গোলাপ, দেলোয়ার হোসেন, মৃণালকান্তি দাস, শামসুন্নাহার চাঁপা, মেহের আফরোজ চুমকি, সিদ্দিকুর রহমান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কামরুল ইসলাম, এ বি এম রিয়াজুল কবির কাওছার, আনোয়ার হোসেন, ইকবাল হোসেন অপু, সানজিদা খানম, শাহাবুদ্দিন ফরাজী ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন।

সর্বশেষ খবর