বৃহস্পতিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

অশান্ত ক্যাম্পে বেপরোয়া রোহিঙ্গারা

আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বাড়ছে অন্তর্ঘাত, কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে সাধারণ রোহিঙ্গা

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা নিয়ে আধিপত্য, ক্যাম্পের দখলদারি বজায় রেখে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টাসহ নানামুখী হিসাব-নিকাশে অস্থির হয়ে উঠেছে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। এরই মধ্যে ক্যাম্পের ভিতরে গড়ে উঠেছে নানা গ্রুপ-উপগ্রুপ। বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সংঘর্ষ, প্রাণহানি। রোহিঙ্গাদের এ অভ্যন্তরীণ বিরোধে প্রশাসন যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে পুলিশ প্রশাসন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়, মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা ইয়াবা ও নানা ধরনের মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্য, সংগঠনভিত্তিক এলাকা দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত চলছে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বেশির ভাগেই একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত এক সপ্তাহে শুধু উখিয়ার কুতুপালং ও লম্বাশিয়া ক্যাম্পে দফায় দফায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছে সাত রোহিঙ্গা। আহত হয়েছে শতাধিক। গত দুই মাসেই পারস্পরিক অন্তর্ঘাতে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। উখিয়া থানার ওসি তদন্ত গাজী সালাহউদ্দিন জানান, ৪ অক্টোবর দুজন, ৫ অক্টোবর একজন ও ৬ অক্টোবর চারজন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে এখনো উত্তেজনা চলছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ থাকায় ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। এ ঘটনায় কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ টেকনাফের চাকমারকুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৯ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করেছে।

জানা গেছে, গত তিন বছরে কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় ক্রসফায়ার ও রোহিঙ্গাদের পারস্পরিক সংঘর্ষে এক শর কাছাকাছি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে সক্রিয় রোহিঙ্গা ডাকাতসহ ৬৮ জন। অন্যরা নিহত হয়েছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও অন্তঃকোন্দলে। তিন বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৬৭১ জনকে। বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। ক্যাম্পগুলো দিন দিন অশান্ত হয়ে উঠছে, বেপরোয়া হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। প্রতি রাতেই ক্যাম্পগুলোয় শোনা যায় গুলির শব্দ। ২ অক্টোবর র‌্যাবের একটি দল অস্ত্র কারখানার সন্ধানে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় মধুরছড়া পাহাড় থেকে দুজনকে আটক করে। পরে তাদের একটি কুঁড়েঘর থেকে দেশে তৈরি দুটি বন্দুক, দুটি গুলি ও বেশ কিছু অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আনাস ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এরই জেরে কুতুপালং ক্যাম্পের ওয়েস্ট ব্লকের এক-দুই এবং ইস্ট ব্লকের এক-দুই এলাকায় ৪ অক্টোবর রাতে মুন্না গ্রুপের চার-পাঁচ শ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দা-লাঠি নিয়ে ক্যাম্পের শতাধিক ঝুপড়িঘর ও প্রায় ৫০টি দোকান ভাঙচুর করেছে। এ ঘটনায় আনাস গ্রুপ ক্ষিপ্ত হয়ে মুন্না গ্রুপের ওপর চড়াও হয়। এভাবে সপ্তাহজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলে আসছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গোলাগুলি শুরু হয়। ইতিমধ্যে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে কয়েক শ সাধারণ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের ভিতরের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ও অন্যান্য অপরাধে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে ৭৩১টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ, ১০টি ডাকাতি, ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা রয়েছে। চলতি বছর ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে হওয়া ১৮৪ মামলায় আসামি করা হয় ৪৪৯ জন। এদিকে দিন যত যাচ্ছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অপরাধ বেড়ে চলেছে। জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্পে সরকারি হিসাবেই ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। ক্যাম্পগুলোকে তারা মাদক, ইয়াবা, অস্ত্রের মজুদ বানিয়ে ফেলেছে। অপরাধের মাত্রা বেড়ে এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যেই প্রায় প্রতি রাতে ক্যাম্পে সংঘর্ষ চলে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, রোহিঙ্গারাই এখন ইয়াবা ও মাদকের বড় বাহক। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচারের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে। বড় চালান আনার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতেও ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক বিক্রি হয়।

কুতুপালং ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আতিকুর রহমান বলেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের দুটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে অনেক দিন ধরে। এর আগেও দুই গ্রুপের মধ্যে বেশ কয়েকবার ছোট-বড় সংঘর্ষ ঘটেছে। এতে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এদিকে কক্সবাজার সুশীলসমাজের প্রতিনিধি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মাদক, চোরাচালান, অপহরণ, অস্ত্র ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তারা। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে। তাদের অবাধ যাতায়াত যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে দেশ থেকে ইয়াবা নির্মূল অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি জানান, বেশ কিছু এনজিও রয়েছে, যারা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। এসব সংস্থার বিরুদ্ধেও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে অপরাধীদের টার্গেট করে সেখানে যখন-তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। এ সুযোগে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘটছে অপরাধ কর্মকান্ড। অধিকাংশ ক্যাম্প দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে হওয়ায় ডাকাতদলের অপরাধ কর্মকান্ডও বেড়েছে। ফলে অপরাধীদের জন্য নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে ক্যাম্প। বিশেষ করে ইয়াবা মজুদ ও লেনদেনের জন্য ক্যাম্পগুলো ব্যবহার করছে অপরাধীরা। তাই এখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা চলছে। কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্প থেকে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের খবর পাওয়া যায়। তবে ক্যাম্পে অপরাধ বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর