সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কোথাও নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি

মাস্ক ব্যবহার করে না কেউই, উৎকণ্ঠা চিকিৎসকদের

নিজামুল হক বিপুল

শুক্রবার রাত ১টা ২০ মিনিট। মৌলভীবাজারের শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশন। সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি থামতেই হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠতে লাগলেন যাত্রীরা। মিনিট তিন পরই ট্রেনটি শমসেরনগর স্টেশন ছেড়ে গেল। ট্রেনের ভিতর ঢুকতেই চোখ কপালে উঠে গেল। রীতিমতো পিলে চমকানো অবস্থা। ট্রেনের ‘ঞ’ নম্বর কোচ। ৬০টি আসনের প্রতিটিতেই যাত্রী রয়েছেন। ট্রেনে বুফে কার বা খাবারগাড়ির দায়িত্বে থাকা কর্মচারী ও হকারদের অবাধ যাতায়াত। কিন্তু কারও মুখেই মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্ব মানা তো দূরের কথা! জানা গেল, শুধু উপবন নয়, ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী প্রতিটি আন্তনগর এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেন চলছে শতভাগ যাত্রী নিয়ে। ট্রেনে চলাচলকারী এসব যাত্রীর বলতে গেলে শতভাগই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে চলাচলকারী সব ট্রেনেই একই অবস্থা! স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি এবং কভিড-১৯ নিয়ে সরকারের সব নির্দেশনা ‘গুহায় গেছে’। ৮ মার্চ দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটির মাধ্যমে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। দফায় দফায় সেই ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে দিয়ে সবকিছু শিথিল করে দেয়। সরকারের নির্দেশনায় সীমিত আকারে ও সীমিত সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সারা দেশে গণপরিবহন এবং ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১ জুন থেকে। প্রথম দিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব যানবাহন চলাচল শুরু করলেও কিছু দিন যেতে না যেতেই ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে সব বিধিনিষেধ উবে যায়। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে আগের অবস্থায় ফিরে আসে গণপরিবহন ও ট্রেন। এদিকে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে টিভি-রেডিওতে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। তবে মাঠপর্যায়ে এর কোনো প্রভাব নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানতে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সারা দেশে মানুষকে সচেতন করতে মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হলেও কোনো তৎপরতা নেই। মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষ কোনো নিয়মকানুন মানছেন না বললেই চলে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্য ছোট-বড় শহরগুলো থেকে শুরু করে গ্রামীণ হাট-বাজার কোথাও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হচ্ছে না। লোকজন মাস্ক ব্যবহারে মোটেই উৎসাহ দেখাচ্ছে না। আর সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি শুধুই কাগজে-পত্রে। কভিড-১৯ যে একটা মরণব্যাধি সে নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। অথচ কভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে লোকজনের মধ্যে বেশ ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক দেখা গিয়েছিল। সরকার যেখানে বেশি মানুষ জমায়েত হতে নিষেধ করেছে, সেখানে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখন বিয়ের হিড়িক পড়ে গেছে। বরযাত্রীর বিশাল বহর নিয়ে বিয়েতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে দেশের অনেক এলাকায়। এদিকে ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কভিডের দ্বিতীয় ধাক্কা বা ঢেউ শুরু হয়েছে। ইউরোপের অনেক দেশে ইতিমধ্যে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। বাংলাদেশে এখনো প্রতিদিন গড়ে ২৫ জনের বেশি লোক কভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তের সংখ্যা কমছে না কোনো কিছুতেই। এ অবস্থায় ২২ সেপ্টেম্বর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের প্রধানদের নিয়ে কভিডের দ্বিতীয় ধাক্কা বিষয়ে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভা থেকেও কভিডের দ্বিতীয় ধাক্কার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর। স্বাস্থ্যবিধি মানলেই কভিডের আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে বারবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও দেশের কোথাও বিশেষ করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, হাট-বাজারে স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণ জানতে চাইলে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘দেখুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ গণমাধ্যমে প্রচারণা ছাড়া আর কোনো কাজ করেনি।’ তিনি বলেন, প্রথম দিকে মানুষ কিছুটা ভীত হয়েই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। এখন ছয়-সাত মাসে নানা কারণে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মনে করছে কিছুই হবে না। এখন মানুষকে সচেতন করতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগ, বিভিন্ন এনজিও, সামাজিক সংগঠন সবাইকে একযোগে গ্রাম পর্যায়ে জনসচেতনতা উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতে হবে। এর জন্য কয়েক সপ্তাহ বা মাস সময় লাগবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ মাঠপর্যায়ে গ্রামীণ যুবক-তরুণদের নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভলান্টিয়ার তৈরি করতে পারে, যারা মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সচেতন করবে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে।

সর্বশেষ খবর