বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

৭৭০ নদীতে ৪৯ হাজার প্রভাবশালীর থাবা

নিজস্ব জনবল নেই নদী কমিশনের, ডিসিদের ওপর নির্ভরশীল, রক্ষায় দুই তীরে প্রয়োজন হাঁটা পথ বা সড়ক নির্মাণ, থমকে থাকা উচ্ছেদ অভিযান আবার শুরু

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

৭৭০ নদীতে ৪৯ হাজার প্রভাবশালীর থাবা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ (বাঁয়ে), আশুলিয়ার নয়নজুড়ি নদী দখল (ডানে) -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের সব নদ-নদীতে পড়েছে দখলদারের থাবা। সারা দেশের ৭৭০ নদ-নদীর বিভিন্ন অংশ ৪৯ হাজার ১৬২ জন প্রভাবশালীর দখলে। নদী দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে ঘরবাড়ি, বাসস্ট্যান্ড, কারখানা, রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ও উপাসনালয়। নিজস্ব জনবল না থাকায় নদী উদ্ধারে জেলা প্রশাসকদের ওপর নির্ভরশীল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কিছু জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চললেও সপ্তাহ না যেতেই ফের দখল হয়ে যায় নদী। রাজনৈতিক চাপ, আর্থিক ও জনবল সংকটে জেলা প্রশাসনও নদী দখলমুক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে হাই কোর্টের রায়ে নদী দখলকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। জানা যায়, নদীর জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসকদের অধীনে প্রাথমিকভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। নদীর দখলদার উচ্ছেদে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই। নদী রক্ষা কমিশন থেকে সব জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। করোনাকালে নদী উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। সম্প্রতি নতুন করে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদিকে জেলা প্রশাসকরা নদী দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহে আর্থিক বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে ৭৭০টি নদ-নদীর দখলদারদের তালিকা আমরা প্রকাশ করেছি। নদীগুলো দখলমুক্ত করতে জেলা প্রশাসকদের চিঠিও দিয়েছি। তাদের ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে বলেছি। অনেকেই ওই কর্মসূচির মাধ্যমে নদী দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করেছেন। করোনাভাইরাসের কারণে আমরা কিছুদিন কাজ করতে পারিনি। সম্প্রতি আবারও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। নদী দখলমুক্ত করতে কাজও শুরু হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত জনবল ও আর্থিক সমস্যাও আছে। সে নিয়েও আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা ৪৯ হাজার ১৬২ দখলদারের হাত থেকে দেশের সব নদ-নদী দখলমুক্ত করবই।’

সারা দেশের ৭৭০ নদ-নদী দখল করে রাখা দখলদারদের তালিকা ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে নদী কমিশন। জেলা প্রশাসকদের পাঠানো এ তালিকায় প্রতিটি জেলায় তৈরি করা হয়েছে দখলদারের নাম। তালিকায় দেখা যায়- ফরিদপুরে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪৩, পাবনায় ৩৩৮, পটুয়াখালীতে ৬০৩, খাগড়াছড়িতে ২৬, সাভারে ৬৫, কুমিল্লায় ৫ হাজার ৫৮৯, নরসিংদীতে ২৫০, ঝিনাইদহে ১৬৯, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪৩, পিরোজপুরে ১২৯, যশোরে ৬০৭, কিশোরগঞ্জে ১১৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬৭১, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ১৭, রাজশাহীতে ১৭৯, চাঁদপুরে ৪৯৭, চুয়াডাঙ্গায় ১ হাজার ২৮৩, ভোলায় ৪৫৪, মানিকগঞ্জে ৪১৮, জয়পুরহাটে ৮০, নওগাঁয় ১৯৩, নড়াইলে ৯৭, নরসিংদীতে ২৫০, নাটোরে ১ হাজার ৪৮৪, দিনাজপুরে ১ হাজার ৪৭, শরীয়তপুরে ২৭৪, রাজবাড়ীতে ২৬, মৌলভীবাজারে ১২৫, কুষ্টিয়ায় ৪৫৪, গোপালগঞ্জে ৫২৫, নোয়াখালীতে ৪ হাজার ৩৮৯, বান্দরবানে ৩৬৮, চট্টগ্রামে ২ হাজার ১৭৮, মুন্সীগঞ্জে ৫৭, খুলনায় ২৮১, শেরপুরে ১১৮, মাদারীপুরে ৩৭৯, বরগুনায় ১ হাজার ৫৫৪, রাঙামাটিতে ৫১, সুনামগঞ্জে ৬৯৬, ঝালকাঠিতে ২০৪, ফেনীতে ৩০১, নারায়ণগঞ্জে ১৭৩, বরিশালে ২ হাজার ৩৩৩, ঝালকাঠিতে ১৭০, সিলেটে ৩৩০, কক্সবাজারে ২৬৬, মাগুরায় ১৩৩ জন দখল করেছেন নদ-নদী। বাকি জেলার নদ-নদীও রয়েছে দখলদারদের দখলে। ময়মনসিংহ শহরের গা-ঘেঁষে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। এ নদের ব্রিজের পুব পাশে ভরাট করে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। ত্রিশালেও অবাধে চলছে নদী দখল।

দেশের ৭৭০টি নদ-নদীর মধ্যে ৩৭টি সবচেয়ে বেশি দখল-দূষণের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে- রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল; কুমিল্লা অঞ্চলের ডাকাতিয়া; চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী, হালদা; নেত্রকোনার মগড়া; খুলনার ময়ূর; হবিগঞ্জের খোয়াই, সোনাই; সিলেট অঞ্চলের সুরমা, পিয়াইন, বিবিয়ানা, খাসিয়া; চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ অঞ্চলের নবগঙ্গা; টাঙ্গাইলের লৌহজং, লাঙ্গুলিয়া; ঢাকা অঞ্চলের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বংশী; কক্সবাজারের বাঁকখালী; ময়মনসিংহ অঞ্চলের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র; রংপুরের ঘাঘট, ইছামতী; দিনাজপুরের পুনর্ভবা; বগুড়ার করতোয়া; নওগাঁ-জয়পুরহাটের ছোট যমুনা; নাটোরের নারদ; তুড়িগ্রামের সোনাভরি; বরিশাল অঞ্চলের সন্ধ্যা; ফরিদপুরের কুমার; সাতক্ষীরার আদি যমুনা; যশোরের কপোতাক্ষ, ভৈরব; নরসিংদী অঞ্চলের হাঁড়িধোয়া ও গাজীপুরের চিলাই।

প্রতিবেদনে জানা যায়, ৩৭টি নদ-নদীতে তিন ধরনের দখল রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্থায়ী আবাসন বা বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়াও সরকারি অপরিকল্পিত স্থাপনার মাধ্যমেও নদ-নদী দখলের শিকার হচ্ছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা বলতে সাধারণত পরিকল্পনাহীন ও অবৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত আড়াআড়ি সড়ক, বাঁধ ও স্লুইস গেটকে বোঝায়। এমন দখলের শিকার বৃহত্তর রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদ। আশির দশকে এ নদের সঙ্গে গঙ্গার সংযোগস্থলসহ ভাটিতে তিনটি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। পরে পাবনার কাবিখা ও কাবিটার অর্থে নির্মিত হয় আড়াআড়ি সড়ক। ফলে নদটি বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং নাটোরের বনগ্রামে একটি ধারা দখলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থা নদী দখলদার ও তাদের পরিচয় চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। ৫৩ জেলার ২৩০টি নদ-নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দখলদারদের পেছন আছেন ১১৮ প্রভাবশালী ব্যক্তি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু নেতা-কর্মীও আছেন। এর সঙ্গে চার ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার সংযোজনীও দেওয়া হয়েছে। দখল রোধে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ ছয় দফা সুপারিশ করা হয়েছে। ভূমি ও নৌ সচিবের দফতরেও এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।

দখলদারের তালিকায় দেখা যায় বেশির ভাগ স্থানীয় ব্যক্তি নদী-খাল দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়ি করেছেন। রাজধানীর উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যা, তুরাগ নদ-নদীতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীর জায়গা দখল করে রেখেছে। দখলে জর্জরিত বন্দরনগর চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদী, চাক্তাই খালসহ দেশের প্রায় সব বড় নদ-নদী, খাল-বিল। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নদ-নদী, খাল-বিল অবৈধ দখল হয়ে যাওয়ায় পানিপ্রবাহের গতিপথ বদলে যাচ্ছে। নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ ব্যাহতের পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। এতে জনগণের ফসল ও ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়। কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর ১২ একর মাছের ঘের করে দখল করেছেন ১০ জন। এর বাইরে ৪৮ জন মিলে এ নদীর ১৩ একর জমি বাড়ি করে দখল করে রেখেছেন। সাঙ্গু নদের ২৪৩ শতক জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন ২৮৫ জন। পটুয়াখালীর লোহারিয়া ও লাউকাঠি নদীর জায়গা দখল নিয়েছেন ৩০১ জন। তাদের অনেকে মামলা করেছেন। পাবনার ইছামতী নদী ও তীরবর্তী জায়গা দখল করে রেখেছেন ২৮০ ব্যক্তি। নদ-নদী, খালের পাশাপাশি বিলও দখলে চলে গেছে। রাজশাহীর তানোরে বিলকুমারীতে অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে ১০৯ জন। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ধান চাষের নামে দখলদাররা বিলের জায়গা দখলে নেন। নদী-খাল দখলদারদের সঙ্গে সরকারি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নদী দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মনিটরিং না করায় ফের দখল হয়ে যাচ্ছে। গত বছরের ১ জুলাই প্রকাশিত উচ্চ আদালতের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রায়ে সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা এবং নদ-নদী সুরক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে এর আইনগত অভিভাবক ঘোষণা দেওয়া হয়। স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে নদী কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। তারা শুধু নামসর্বস্ব সুপারিশ করলেই হবে না, তাদের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকলে চলবে না। নদীকে বাঁচাতে হলে এর অভিভাবকত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। নদী রক্ষা কমিশনই এর দায়িত্ব নিতে পারে। এ নিয়ে নদী রক্ষা কমিশনের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে কাজ করতে হবে। কারণ, বিআইডব্লিউটিএ শুধু নৌযান চলাচল নিয়ে ব্যস্ত। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী ভাঙন ঠেকানোয় ব্যস্ত। কিন্তু নদীর কান্না, দূষণ বা দখল ঠেকানোর সেই অর্থে কেউ নেই। এজন্যই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের অধীন সব সংস্থা এক হয়ে কাজ করলে নদীর কান্না বন্ধ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর