বৃহস্পতিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ব্যুরোক্রেসির মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি

বাধাগ্রস্ত উন্নয়ন কর্মকান্ড, সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

নিজামুল হক বিপুল

ব্যুরোক্রেসির মুখোমুখি জনপ্রতিনিধি

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যুরোক্রেটদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। অনেক স্থানে জনপ্রতিনিধিদের হাতেই লাঞ্ছিত হচ্ছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। মানসিক নির্যাতন থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন তারা। এ কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্তও করছে সরকার। একইভাবে দেশের অনেক স্থানে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) শুনছেন না মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা। এসব কারণে মাঠ প্রশাসন এবং মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। সম্পর্ক শীতল হচ্ছে। কোথাও কোথাও ঠান্ডা যুদ্ধও হচ্ছে। দূরত্ব এতটাই শীতল হয়েছে যে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করাচ্ছেন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা। মন্ত্রী-এমপিদের মতো, উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দূরত্ব বাড়ছে স্থানীয় প্রশাসনের। ইউএনওরা সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ না করায় উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে আছে। এ নিয়ে চেয়ারম্যান ও ইউএনওর মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য আকার ধারণ করেছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রিট করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দ্বন্দ্ব বাড়ছে পৌরসভার মেয়রদের সঙ্গে। দেশের কোথাও কোথাও পৌর মেয়রদের অনৈতিক কথা না শোনায় কর্মস্থল থেকে পালাতে হয়েছে কর্মকর্তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক এলাকা থেকে কর্মকর্তারা হয় পালিয়ে যাচ্ছেন না হয় অন্য এলাকায় পোস্টিং নিচ্ছেন। গত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই এমন পরিস্থিতি চলছে, যা দিন দিন বাড়ছে। এ পরিস্থিতি এখনই সামাল দিতে না পারলে ভবিষ্যতে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব আরও বৃহৎ আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে হুমকি এবং ইউএনওর ফোনে এসি ল্যান্ডকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনের বিচার চেয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। গতকাল এক বিবৃতিতে বিএএসএ এ দাবি জানায়। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ যে তুঙ্গে উঠেছে সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় তা পরিষ্কার। পাবনার বেড়া পৌরসভার মেয়র আবদুল বাতেন গত সোমবার মাসিক সমন্বয় সভায় বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আনামকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিক লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনা সরকারের উচ্চ পর্যায় জানার পর মঙ্গলবার পৌর মেয়র আবদুল বাতেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

এর আগে ২৭ জুলাই মাদারীপুরের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে স্থানীয় আদালতে একটি মামলা করেন একজন বালু ব্যবসায়ী। অভিযোগ, একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির মদদে ওই মামলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের ইজারাবহির্ভূত এলাকা থেকে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় মামলাটি হয়। এ ঘটনায় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে মামলাটি গত মাসে খারিজ করে দেওয়া হয়।

১০ অক্টোবর ছিল ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন। ভোটের দিন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর এক কর্মীকে আটক করার জেরে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে। জেলা প্রশাসক অতুল সরকার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য তাকে এবং নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী তার একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। চরভদ্রাসনের ইউএনও জেসমিন সুলতানাকে ফোন করে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন। ডিসির অভিযোগ পাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও নিক্সন চৌধুরী মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি কাউকে গালিগালাজ করেননি। তার বক্তব্যকে ‘সুপার এডিট’ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে একটি মহল।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হোসেন আশরাফের দাপটে ওই পৌরসভার একজন সহকারী প্রকৌশলী বাজিতপুর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। জানা গেছে, অধিক অর্থ বরাদ্দ নিতে মেয়র বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকল্পের ওপর নতুন করে প্রকল্প তৈরি করে দেওয়ার জন্য পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী কামরুল হাসানকে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই প্রকৌশলী মেয়রের কথা না শোনায় তাকে নানাভাবে তিনি হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। একপর্যায়ে গত জুনে ওই প্রকৌশলী বাজিতপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন। একইভাবে উপসহকারী প্রকৌশলীও (একজন নারী) গা ঢাকা দেন বাজিতপুর থেকে। পরে তিনি বদলি হয়ে করিমগঞ্জ পৌরসভায় যান। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানার পর সম্প্রতি এ ব্যাপারে তদন্ত করেছে। জানা গেছে, গতকালই আবুল বাশার নামে একজন সহকারী প্রকৌশলী বাজিতপুরে যোগদান করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, মেয়র তার বড় ভাই স্থানীয় সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের প্রভাব খাটিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় গত মে মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক হামলার শিকার হন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইশারায় উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলের পশুরবুনিয়া স্পটে বালু উত্তোলনকারীরা ইউএনওর ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর নিজের সরকারি বাসভবনে নির্মম হামলার শিকার হন ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম। এ হামলার কারণ এখনো রহস্যাবৃত। এ ছাড়া সাম্প্রতিক এসব ঘটনার বাইরে গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত সাতজন ইউএনও আক্রান্ত হয়েছেন। জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে মূলত বালুমহাল, জলমহাল, খাসজমি, হাটবাজার ও খেয়াঘাট ইজারাকে কেন্দ্র করে। জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছা অনুযায়ী ডিসি বা ইউএনও বরাদ্দ না দিলে ক্ষিপ্ত হন প্রভাবশালীরা। সেখান থেকেই নানারকম হুমকি-ধমকি ও মানসিক নির্যাতন, কখনো কখনো শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা যেমন সরকারি সম্পদ রক্ষা কিংবা কোনো উন্নয়ন কর্মকা- সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে আক্রান্ত হন, আবার উল্টো ঘটনাও আছে। অভিযোগ আছে, জনপ্রতিনিধির অনেকের কথায়ই আমল দেন না স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্থানীয় এমপি ইউএনওকে কোনো নির্দেশনা দিলে ডিসি দেন আরেকটা নির্দেশনা, যা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে।

এর বাইরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বিরোধ চলছে ইউএনওদের। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরকারের ১৭টি বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো সবই কাগজপত্রে। বাস্তবে ইউএনওরাই হচ্ছেন সর্বেসর্বা। চেয়ারম্যানদের কোনোরকম পাত্তা দিচ্ছেন না তারা। এ নিয়ে চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে অসংখ্যবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানো হয়েছে। সর্বশেষ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকেও লিখিতভাবে জানিয়েছে উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে রিট করার দিকে এগোচ্ছেন চেয়ারম্যানরা। শিগগির এ রিট করা হবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ হাওলাদার। সাম্প্রতিক এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মনে করি, একজন সংসদ সদস্য বা একজন মেয়র যে-ই হোন না কেন, তিনি যদি অপরাধ করে থাকেন আর তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে। ইতিমধ্যে মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, আর এমপির বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলছে নির্বাচন কমিশন।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারাও যদি দোষী হন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে এ রকম সমস্যা আর তৈরি হবে না।’ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবদুল করিম বলেন, ‘এগুলো মোটেই কাম্য নয়। মাঠ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে সুসম্পর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়। আইনের প্রতি সবার সমান শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, মাঠ পর্যায়ে যদি শৃঙ্খলা না থাকে তাহলে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। কারণ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তখন কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।’ তিনি বলেন, ‘ডিসি সব সময় তার জেলা প্রশাসনের যেমন, স্বাস্থ্য, মৎস্য, বন, শিক্ষা, দুর্যোগসহ জেলার সব দফতরের কর্মকান্ড সমন্বয় করে থাকেন। এখানে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের সুসম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।’ আবদুল করিম বলেন, ‘এসব ঘটছে মূলত আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে। আইনে নির্ধারণ করা আছে কার কী কাজ, কার ক্ষমতা কতটুকু, উপজেলা চেয়ারম্যান কী করবেন, ইউএনও কী করবেন, সবই আইনে বলা আছে। আইন মান্য না হলে এ রকম সমস্যা হবে।’ তিনি বলেন, ‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা আগেও ছিল, পাকিস্তান আমলেও ছিল, এখনো আছে। এটা থাকা উচিত নয়। সুসম্পর্ক থাকা জরুরি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর