শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

নাগালের বাইরে নিত্যপণ্যের বাজার

হুজুগেই দাম বাড়ে সবজির, হয় না বাজার মনিটরিং, টানানো থাকে না মূল্য তালিকা

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

নাগালের বাইরে নিত্যপণ্যের বাজার

রাজধানীর একটি কাঁচাবাজার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। মাস দু-এক ধরে কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, টমেটোর দাম চড়া। হালে রেকর্ড করেছে আলুর দাম। ১০ দিনের ব্যবধানে প্রতিটি সবজির দাম ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। ৬০-৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। লাগামহীন দামে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। একবার পণ্যের দাম বাড়লে আর কমার লক্ষণ দেখা যায় না। দাম নির্ধারণ, বাজার মনিটরিং কোনো কিছুতেই ফলোদয় হচ্ছে না। মূল্য তালিকা টানানো নেই অধিকাংশ বাজারে। কোথাও কোথাও তালিকা থাকলেও কার্যকর

নেই। বাজার পর্যবেক্ষণে সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, আলুর উৎপাদন বা সরবরাহে কোনো সংকট নেই। সব মিলিয়ে খুচরা বাজারে ৩০ টাকার বেশি দাম হওয়ার কথা নয়। হুজুগে মাঝেমধ্যেই একটি করে সবজির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা কেজি। এর সঙ্গে বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় অন্য সবজির দামও তুঙ্গে। কাঁচা মরিচ পাইকারি বাজারে ২০০-২২০ আর খুচরা বাজারে ৩০০-৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে দেশি পিঁয়াজের দাম এখনো ১০০ টাকার কাছাকাছি। নিত্যপণ্যের অসহনীয় দর সাধারণ ক্রেতাদের বিশেষ করে করোনায় আয় কমে যাওয়া মানুষজনকে এখন বেশি ভোগান্তিতে ফেলেছে। কম আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সরকারকে বলা হয় ব্যবসাবান্ধব। আমি মনে করি, এখন সরকারকে হওয়া উচিত ভোক্তাবান্ধব। সবাই বলছে, চাল, আলুর উৎপাদন কিংবা সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। তাহলে দাম বাড়ছে কেন? সরকার-নির্ধারিত দামে কেউ পণ্য বিক্রি করছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে সরকার রেফারির ভূমিকায়। সরকার যদি কঠোর না থাকে তাহলে খেলোয়াড়রা ফাউল করবেই। আর যদি ফাউল করা খেলোয়াড়দের লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়, তাহলে অন্য খেলোয়াড়রা সতর্ক হয়ে যাবে। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হিমাগারে গিয়ে দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে। সেখানে কেউ ফাউল করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মূলত বাজার মনিটরিংয়ে রেফারির ভূমিকায় থাকা সরকারকেই কঠোর হতে হবে।’

কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারে পাইকারি দরে কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, শিম ১২০-১৪০, গাজর ৭০-৮০, বেগুন আকারভেদে ৭০-১১০, ধনেপাতা ২৩০-২৫০ টাকা। কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে দেশি শসা বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০, হাইব্রিড শসা ৬০, করলা ৬০-৭০, উচ্ছে ৮০-৯০, ঝিঙ্গা-ধুন্দল ৬০, চিচিঙ্গা ৬০, কাঁকরোল আকারভেদে ৭০-৮০, ঢেঁড়স ৬০, পটোল ৬০, পেঁপে ৪০, কচুর মুখী ৫০, আলু ৪৫, কচুর লতি ৫০-৬০, মিষ্টিকুমড়া ৩৫-৪০ টাকা। এ ছাড়া টমেটোর কেজি ৮০-১০০, প্রতি হালি কাঁচকলা ৩০, প্রতি পিস চালকুমড়া ৪০-৫০, লাউ ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লালশাক বিক্রি হচ্ছে আঁটিপ্রতি ৫-৮, মুলা ও কলমি শাক ৮-১০, পুঁইশাক ১৫, ডাঁটাশাক ১৫ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকায়। আমদানি করা পিঁয়াজ ৭০-৭৫ টাকা। চীনা আদা ২২০ টাকা। দেশি মসুর ডাল ৯০-১২০ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ৯০-১০০, চিনি প্রতি কেজি ৬৫ টাকা। কারওয়ান বাজারে প্রতি কেজি আটাশ চাল ৫০, পাইজাম ৪৮, মিনিকেট ৫৬, জিরা মিনিকেট ৫৫, নাজিরশাল ৫৫, পোলাও চাল (খোলা) ৯৫-১০০ টাকা। কারওয়ান বাজারের আলু বিক্রেতা শিপলু মিয়া বলেন, ‘পাল্লাপ্রতি (৫ কেজি) আলু বিক্রি করছি ২৪০-২৫০ টাকায়। দাম বাড়লে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ দাম বাড়ায় বড় ব্যবসায়ীরা। অথচ ক্রেতাদের গালি আমাদের শুনতে হয়।’

বাজারে খাসির মাংস কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮১০-৮৩০ টাকায়, গরুর মাংস ৫৫০। বর্তমানে এ বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০, লেয়ার ২২০, সোনালি মুরগি ২১০-২৩০, দেশি মুরগি ৪৫০ টাকা। তবে পাইকারি এ বাজারে অপরিবর্তিত আছে মাছের দাম। প্রতি কেজি রুই (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২৮০, মৃগেল ১৬০-২৫০, পাঙ্গাশ ১৪০-১৬০, কাতল ১৭০-২৮০, তেলাপিয়া ১০০-১৫০, কই ১৪০-১৬০, পাবদা ২৭০-৩০০, কাঁচকি ২৫০-৩০০, মলা ২৮০-৩০০, দেশি টেংরা ৩৫০-৪৫০, শিং (আকারভেদে) ২৫০-৬০০, দেশি চিংড়ি (ছোট) ৩০০-৪০০ টাকা।

কারওয়ান বাজারে সপ্তাহের বাজার করতে এসেছিলেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পাইকারি দরে সবজি কিনতে এ বাজারে আসি। কিন্তু দাম নাগালের বাইরে। একবার কোনো সবজির দাম বাড়লে তা আর কমে না। পিঁয়াজের দাম গত বছর থেকেই ওঠানামা করছে। কাঁচা মরিচের দাম ২০০ থেকে ৩০০-এ ঘরে। টমেটোর দাম সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। কিন্তু এসবের তো কোনো সমাধান দেখি না। করোনার কারণে কোম্পানি থেকে বেতনের ২০ শতাংশ কমানো হয়েছে। এ আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’ উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারে গোল বেগুন ১০০, লম্বা বেগুন ৮০, পটোল ৮০, ঢেঁড়স ৮০, চিচিঙ্গা ৮০, পেঁপে ৫০, কচুর মুখী ৮০, আলু ৪৫-৫০, টমেটো-১২০, শসা ১০০, শিম ১২০-১৫০, গাজর ১০০, ঝিঙ্গা ৮০, কাঁচা মরিচ ৩০০-৩২০, বরবটি ১০০, লাউ ৬০-৮০ (পিস), মিষ্টিকুমড়া ৫০, চালকুমড়া (পিস) ৪০-৫০, ফুলকপি (পিস) ৫০, বাঁধাকপি (পিস) ৫০, লেবু (হালি) ৩০, কাঁচকলা (হালি) ৪০। মাছের বাজারে রুই ৩০০-৩৫০, কাতল ২৬০-২৮০, বোয়াল ৪৫০, পাঙ্গাশ ১২০-১৩০, কই (চাষের) ১৬০, শিং ৩৫০-৫০০, তেলাপিয়া ১৫০ টাকা কেজি। দেশি মুরগি ৪৫০, সোনালি মুরগি ২২০-২৩০, ব্রয়লার মুরগি ১২৫ টাকা কেজি। এ বাজারে সয়াবিন তেল ১০০-১১০ টাকা লিটার।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (গবেষণাগার) প্রণবকুমার প্রামাণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীতে আমরা চারটি টিম বাজার পর্যবেক্ষণে কাজ করি। আমি যাত্রাবাড়ীতে আলু ও পিঁয়াজের আড়তে অভিযান পরিচালনা করেছি। সেখানে ১২ হাজার টাকা জরিমানাও করেছি। আলুর পাইকারি মূল্য ২৫ টাকা এবং খুচরা মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি। আমি মনে করি, এভাবে পাঁচ-দশটি টিম কয়েকটি বাজার পর্যবেক্ষণ করলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। এজন্য পুরো বাজারব্যবস্থাকে একটি সিস্টেমে নিয়ে আসতে হবে। নইলে দামের হেরফের হবেই। এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। কাজও চলছে।’

জানা যায়, দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানকালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হচ্ছে। প্রতিদিন জরিমানা করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদেরও। কিন্তু মনিটরিং টিমের সীমাবদ্ধতা ও কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে সবজির দাম। বিভিন্ন অজুহাতে দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে বাজারে স্বস্তি ফিরবে না বলে মনে করেন ভোক্তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম প্রতিদিন সকালে বাজার মনিটরিং করে। এ টিমকে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে, প্রতিটি বাজারে যেন মূল্য তালিকা টানানো থাকে এবং সে তালিকা অনুযায়ী পণ্যের দাম রাখেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাজারে মূল্য তালিকার খোঁজ মেলে না। যার কাছে যেমন ইচ্ছা দাম রাখেন ব্যবসায়ীরা।

মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণসমাবেশ : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল বেলা ১১টায় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণসমাবেশ করে। সেখানে বক্তারা বলেন, শাসকের অনুগ্রহভাজন মজুদদার ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে নিত্যপণ্যের বাজারে চরম মুনাফাবাজি চলছে। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য খেটে খাওয়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পরও আলুর দামে লাগাম লাগানো যায়নি। একদিকে করোনা মহামারীতে জনগণের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকারের প্রতি আহ্বান- অনতিবিলম্বে কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। অন্যথায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জনগণ রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। তখন অসাধু মজুদদার ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আপনাদেরও চেয়ার কেঁপে উঠবে। সংগঠনের সমন্বয়ক, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সাধারণ সম্পাদক সামছুল আলমের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন কৃষক মোর্চার আহ্বায়ক মোহাম্মদ মাসুম, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সিরাজুল ইসলাম, কৃষক নেতা বিধান দাস প্রমুখ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর