শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা
মন্তব্য কলাম

রাষ্ট্রীয় মদদে পূর্ণিমা ধর্ষণে কেঁদেছিল বিশ্ব বিবেক

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

রাষ্ট্রীয় মদদে পূর্ণিমা ধর্ষণে কেঁদেছিল বিশ্ব বিবেক

‘আমার মেয়েটি একেবারেই বাচ্চা, তোমরা একজন একজন করে এসো, নয়তো আমার বাচ্চা মেয়েটি মারা যাবে।’ সেদিন পূর্ণিমা শীলের গর্ভধারিণী মায়ের সেই আকুতি প্রাণ গলাতে পরেনি বিএনপি, জামায়াত পাষন্ডদের। প্রায় ১০/১২ নরপিশাচ ১২ বছরের পূর্ণিমার দেহকে গণধর্ষণের মাধ্যমে বিক্ষত করেছিল শকুনের মতো।

 অশ্রু বিসর্জন এবং পরে জ্ঞান হারিয়ে চিকিৎসা নেওয়া ছাড়া পূর্ণিমার কিছু করার ছিল না, ছিল না পূর্ণিমার পিতা-মাতারও। তারা নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন অসহায় হরিণ শাবকের মায়ের মতো যখন সেই শাবককে ভক্ষণ করে হিংস্র সিংহ, কারণ এ যে ছিল রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্ষণের ঘটনা। এটি ঘটেছিল ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিজয়ের পর। আর সেই বিজয়ের পর মুহূর্তেই বিএনপি, জামায়াতের দস্যুরা সারাদেশে নেমে পড়েছিল অভূতপূর্ব বিভীষিকার রাজ্য সৃষ্টি করতে। যার মধ্যে ধর্ষণ ছাড়াও ছিল হত্যা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি। শুধু পূর্ণিমাই যে একজন ধর্ষিতা ছিলেন তা নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশনের দীর্ঘ, বহু গবেষণা এবং তদন্তের পর অত্যন্ত সুচারুরূপে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় মদদে তৈরি নৈরাজ্যকালে কমপক্ষে ২০০ নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। অনেকে পুকুরে, ডোবায় পালিয়েও রক্ষা পাননি, তাদের পুকুর থেকে তুলে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। এ ছিল চরম জিঘাংসার প্রতিফলন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল নৌকায় ভোট দেওয়ার। ধর্ষিতাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের নারীই ছিলেন। যেমন ছিলেন ছবি রানী, শেফালি, কল্যাণী, অনিমা, কিরনবালা তেমনি ছিলেন মুসলমান ফাহিমা, মাহিমা, মৌসুমিও। চরফ্যাশন-লালমোহন এলাকায় এবং লর্ড হার্ডিঞ্জ এবং ভেন্ডল বাড়ি এলাকাজুড়ে শতাধিক মহিলাকে আটকে রেখে জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি কর্মী ও নেতারা পালাক্রমে ১০/১২ দিন ধর্ষণ করে। এদের মধ্যে ছিল মা, মেয়ে, পুত্রবধূ সবাইকে একত্রে ধর্ষণ করা হয়। যার কিছুটা তুলনা করা যায় ’৭১ এর পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ধর্ষণের ঘটনাসমূহ। সেদিন মহিলা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার কোনো চেষ্টা করেনি ওই সব অসুরবৃত্তি রোধ করার। পুলিশের ওপর নির্দেশ ছিল কোনো মামলা গ্রহণ না করার, কেউ ভয়ে থানায় যায়নি। যারা ভয় কাটিয়ে থানা পর্যন্ত গিয়েছিলেন তাদের বলা হয়েছে মামলা না নিতে উপরের নির্দেশ রয়েছে।

১৯৭১ এ পাকিস্তানি নরপিশাচ ছাড়াও এ ধরনের গণধর্ষণের তুলনা হয় নাইজেরিয়ার বোকো হারাম বাহিনীর এবং আইএস বাহিনী কর্তৃক অমুসলিমদের ওপর, এবং মিয়ানমার সৈন্যদের রোহিঙ্গাদের ওপর গণধর্ষণের। এর মধ্যে মিয়ানমারে এবং ২০০১ এর নির্বাচনের পর বাংলাদেশের গণধর্ষণ হয় রাষ্ট্রীয় মদদে। সে দিনগুলোর বিভীষিকাময় ঘটনাগুলো কাঁদিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ডেমোক্রেসি ওয়াচ ছাড়াও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছিল সেই নিষ্ঠুর হায়ানাদের নির্মম নির্যাতনের খবর। এসব করুণ কাহিনী ছাপা হয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তারই ফলশ্রুতিতে ঢাকাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজন করা হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি কেএম সোবহান, অ্যাডভোকেট গাজিউল হাক প্রমুখের নেতৃত্বে ২০০২ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এনজিওগুলোর প্রতিনিধিদের ভিসা দেয়নি বিএনপি, জামায়াত সরকার, ভিসা দেয়নি পাকিস্তানি মানবাধিকার নেত্রী আসমা জাহাঙ্গিরকেও।

তবে উত্তর আমেরিকান জুরিস্ট সমিতির কানাডা চাপ্টারের সভাপতি উইলিয়াম স্টোন জাতিসংঘের পাসপোর্টধারী ছিলেন বলে তাকে থামানো যায়নি- তিনি এসেছিলেন। তখনকার বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধান অতিথি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহারিয়ার কবিরকে বিএনপি সরকার গ্রেফতার করেছিল ২০০১ এ ঘটানো নৃশংসতার প্রতিবাদ করায়। ওই সম্মেলনের কয়েকদিন আগে তিনি মুক্তি পেয়ে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন একজন ভুক্তভোগী হিসেবে। সেই সভাতেই শাহরিয়ার কবির মঞ্চে তোলেন গণধর্ষণের শিকার পূর্ণিমাকে। পূর্ণিমা সে সময় তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের কাহিনী ব্যক্ত করলে সভায় উপস্থিত সবারই চোখে পানি এসেছিল। সরকার সেই সম্মেলন বানচাল করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি, কিন্তু ব্যারিস্টার আমির, বিচারপতি কেএম সোবহান, ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের মতো শক্তিধর ব্যক্তিত্বদের প্রয়াসের কাছে সরকার সেদিন পরাজিত হয়েছিল বিশেষ করে হাজারও জনতার কাফেলা থামাতে না পেরে।

থানা-পুলিশ, তাদের ভাষায় উপরের নির্দেশে, পূর্ণিমার মামলা গ্রহণ না করায় সরাসরি আদালতে মামলা করা হয়। সেই মামলা দায়ের করার জন্য ঢাকা থেকে যেতে হয়েছিল ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলাম, গাজিউল হকসহ অন্য দেশবরেণ্য আইনজীবীদের। গিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনসহ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ। তবে বিএনপি সরকার থাকাকালে বিচারের রায় পাওয়া যায়নি- রায় হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর। সেদিনের বীভৎসতা ফরাসি বিপ্লবের পর ঘটে যাওয়া রেইন অব টেররের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে পার্থক্য হলো ২০০১ এর নৈরাজ্য ছিল রাষ্ট্র প্ররোচিত। আজ যখন ধর্ষণের মহামারীর খবর দেশজুড়ে, তখন অনেকেরই প্রশ্ন সেদিন যদি পূর্ণিমাসহ অন্যদের ধর্ষণের বিচার হতো তাহলে কি ধর্ষণের সংখ্যা কমত? অপরাধবিজ্ঞান বলে বিচারহীনতা অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। সেই অর্থে সেই দিনগুলোর বিচারহীনতা নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও ধর্ষকদের উৎসাহ বাড়িয়েছে। আজ যেসব বিএনপি নেতা ধর্ষণের অপরাধের জন্য বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের কাছে অনুরোধ দয়া করে ২০০১ এর নির্বাচনের পর কি বিভীষিকা আপনাদের দল চালিয়েছিল তা দেশি এবং বিদেশি পত্রিকায় পড়ে দেখুন, তাতে আপনাদের লজ্জা হয় কিনা। তাদের কথা শুনে মনে হয় ভূতের মুখে রাম নাম। ভূপেন হাজারিকার একটি গানের লাইন হলো

              ‘‘মানুষ যদি সে না হয় মানুষ

               দানব কখনো হয় না মানুষ

               যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ

               লজ্জা কি তুমি পাবে না!’’

সেদিনের বর্বরতা দানবকেও লজ্জা দিয়েছিল, এটা ভেবে আপনাদের কি লজ্জা হচ্ছে না?

লেখক : আপিল বিভাগের অবসারপ্রাপ্ত বিচারপতি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর