শিরোনাম
রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

কঠিন যুদ্ধে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত

আয় না বাড়লেও ব্যয় বাড়ছে হু হু করে । দৈনন্দিন খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভাঙছে অনেকেই । চড়া সুদের ঋণের ফাঁদ

মানিক মুনতাসির

কভিড-১৯ মহামারীর আতঙ্ক অনেকটা কেটে গেলেও মানুষের মধ্যে ভর করেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আতঙ্ক। চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, মাছ, মাংস, সবজি সবকিছুর দাম বাড়ছে অবিরাম। সাম্প্রতিক সময়ে পিঁয়াজ ও আলুর দাম নিয়ে ব্যাপক হইচই হলেও ইতিবাচক ফল মেলেনি। চড়া মূল্যেই পণ্য কিনে কোনোরকমে জীবন চালাচ্ছে মানুষ। এমনিতে কভিড-১৯-এর প্রভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য। আবার কেউ কেউ কাজ হারিয়ে দিশাহারা। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। আয় বাড়ছে না। বরং অনেকেরই আয় কমে গেছে কভিডের প্রভাবে। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন অনেকেই। চড়া সুদের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ছে নিম্নবিত্ত ও দিনমজুররা। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে অধিকাংশ মানুষ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের বাসিন্দাদের খরচ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গত বছর পিঁয়াজের কেজি উঠেছিল ২৫০ টাকা। মাঝে কিছুটা কমার পর আবারও    ১০০ টাকায় উঠেছে। সবজির বাজারে তো রীতিমতো আগুন। ফলে বস্তিবাসী, গ্রাম কিংবা শহরের দিনমজুর শ্রেণির মানুষ, রিকশাওয়ালা ও অন্যান্য শ্রমিক অনেক সময় ডাল, আলু ভর্তা আর পিঁয়াজ মরিচ দিয়েও ভাত খেতে পারত। গত প্রায় ছয় মাস ধরে তাও তাদের কাছে অধরা। ফলে এ দুই শ্রেণির মানুষ ধার-কর্জ করে জীবনযাপন করছে। আবার কেউ কেউ নিজেদের নিত্যদিনের বাজেট কমাচ্ছে। ফলে জীবন টিকিয়ে রাখতে গিয়ে কঠিন অবস্থায় মধ্য ও নিম্নবিত্তরা। একদিকে দ্রব্যমূল্যের বিরতিহীন ঊর্ধ্বগতি বাড়াচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিচর্যার অতিরিক্ত খরচ। এতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে সমাজের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে এই শ্রেণির মানুষ। খরচের তালিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে অনেকেই আবার ঢাকা ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। আবার জীবন চালাতে নিম্ন আয়ের মানুষ ও দিনমজুরের অনেকেই মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে চক্রবৃদ্ধি ঋণের জালে আটকা পড়ছে অনেকেই। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ না পেয়েছে সরকারি কোনো সুবিধা, না পারছে কারও কাছে হাত পাততে। নিজেদের কাজ ও চাকরির বেতনও কমেছে অনেকেরই। ফলে তাদের সংকটটা দেখারও কেউ নেই। দাঁতে দাঁত চাপিয়ে সমস্যার সমাধান করতে না পেরে ব্যাংকে থাকা সামান্য সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে বাধ্য হয়েই। কেস স্টাডি-১ : রাশেদুর রহমান। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। করোনার কারণে বেতন কমে গেছে ১০ শতাংশ। থাকেন পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত নিজ বাড়িতে উত্তরায়। এরই মধ্যে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন পরিবারের একাধিক সদস্য। সম্প্রতি অফিসে যাতায়াত খরচ বেড়েছে। সব ধরনের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খাদ্য খরচও বেড়েছে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতে হচ্ছে নিয়মিত। বেড়েছে স্বাস্থ্য পরিচর্যার ব্যয়। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধপত্র কেনাসহ অন্য প্রায় সব রকমের খরচ বেড়েছে। ফলে নিজের বাড়িতে থেকেও জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিজ নামে নিজের ব্যাংকে থাকা ডিপোজিট ভেঙে ফেলেছে জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে। কেস স্টাডি-২ : রোজিনা আক্তার। পেশায় ঝিয়ের কাজ করেন। আগে কাজ করতেন চারটি পরিবারে। কভিড-১৯-এর কারণে ইতিমধ্যে দুই বাসার কাজ হারিয়েছেন। তারা জানিয়ে দিয়েছেন নিজেদের আয় কমে যাওয়ায় নিজের কাজ কষ্ট হলেও নিজেরাই করছেন। ফলে কাজের লোক ছেড়ে দিয়েছেন। এর প্রভাবে রোজিনার আয় কমে গেছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। রামপুরায় এক বস্তিতে ঘর ভাড়া করে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন। সেখানে ঘর ভাড়া দেন ৩ হাজার টাকা। বৃদ্ধ মা প্রায় সব সময় অসুস্থ থাকেন। দুই মেয়ে পড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে থাকলে বিনামূল্যে টিফিন পেত। কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ। ফলে বাচ্চাদের পেছনে খরচ বেড়েছে। এরই মধ্যে মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ফলে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। আগে সপ্তাহে দুই দিন পাঙ্গাশ কিংবা কই মাছ খেতে পারতেন। এখন তা এক দিন কেনেন। বাকি দিন আলু ভর্তা-ডাল খেতেন তাতেও বাগড়া দিয়েছে আলুর বাজারের ঊর্ধ্বগতি। ফলে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। ভাবছেন হয়তো গ্রামেই চলে যাবেন। কিন্তু গ্রামের বাড়িতেও জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই। ফলে তারা পড়েছেন দোটানায়। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্যমতে, নিত্যপণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দাম বেড়েছে মোটা চালের। গত এক বছরে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। শুধু এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। পিঁয়াজের দাম গত এক মাসে বেড়েছে কয়েক গুণ। ২৫ টাকার পিঁয়াজ এখন প্রায় ১০০ টাকায় উঠেছে। ডিমের দামও বেড়ে ডজনপ্রতি ১১৫ টাকায় ঠেকেছে। টিসিবি যেসব পণ্যের বাজার মনিটরিং করে তার তালিকায় প্রায় ৫২টি পণ্যের নাম রয়েছে। এর মধ্যে এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩৫টিরই দাম বেড়েছে; যা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা শহরে করোনার প্রভাবে বিপুলসংখ্যক বাসা-বাড়ি খালি হলেও বাড়ি ভাড়া কমেনি মোটেও। ফলে মানুষের আবাসন খরচ কমেনি। বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। অথচ আয় বাড়েনি। বরং কমেছে। অনেকেই কাজ/চাকরি হারিয়েছে। ফলে জীবন চালাতে মানুষকে জীবনই বাজি রাখতে হচ্ছে। এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসাবে, ঢাকায় গত শনিবার তিন ধরনের মোটা চালের দাম ৫১ থেকে ৫৫ টাকা ছিল। ক্যাব বলছে, ২০০০ সালে একই চাল প্রতি কেজি ১৫ থেকে ১৭ টাকা ছিল। রাজধানীর এক বাসচালক মনির মিয়া বলেন, ‘এই মানের ৫০ কেজির এক বস্তা চাল কিনতে এখন ২৭৫০ টাকা লাগে। সারা মাসে চাল, ডাল কিনতে যে টাকা লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা লাগে সবজি তেল আর ডাল কিনতে। মাছ মাংস না হয় বাদই দিলাম। ঘর ভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার টাকা। বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে হয় ২ হাজার টাকা। মালিক বেতন দেন ১২ হাজার টাকা। ফলে প্রতি মাসেই ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে।’ করোনার কারণে এখন আর ধারও মেলে না বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সব সময়ই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। এবার তা একটু বেশিই হয়েছে। কেননা একে করোনার কারণে মানুষ দিশাহরা, অন্যদিকে পিঁয়াজ, চাল, ডাল, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি। অন্যান্য সবজির বাজারে চরম অস্থিরতা।’ তাঁর মতে, আগে মানুষ সব ধরনের সবজি আর মসলার পেছনে যা ব্যয় করত এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে শুধু পিঁয়াজ আর আলুর পেছনে। আর আয়বৈষম্য তো আমাদের অর্থনীতির একটা পুরনো ইস্যু। কেননা আমাদের সম্পদগুলো অল্প কিছু মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত। ফলে যাদের সম্পদ বেশি তারাই ধনী হচ্ছে। আর যাদের সম্পদ কম বা সম্পদ নেই তারা আগের তুলনায় আরও গরিব হচ্ছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সম্পদ গড়ে তোলা খুব কঠিন।’ প্রায় সব সময়ই তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি বলে তিনি মনে করেন।

সর্বশেষ খবর