সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

উপজেলা পরিষদ-প্রশাসন দ্বন্দ্ব

‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা’ সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছেন না পরিষদকে, সব ক্ষমতাই ইউএনওর হাতে, আজও হস্তান্তর হয়নি ১৭ দফতর

নিজামুল হক বিপুল

সরকারের আইনে আছে উপজেলা পরিষদ। অথচ মাঠ প্রশাসন কোনো চিঠিপত্র লিখলে বা অনুষ্ঠান করলে দাওয়াতপত্র বা ব্যানারে লিখছে উপজেলা প্রশাসন। আইনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উল্লেখ করে পরিষদকে সাচিবিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা থাকলেও ইউএনওরা তা মানছেন না। উল্টো ইউএনওরা উপজেলার সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। এ নিয়েই জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউএনও তথা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার বিরোধ এখন তুঙ্গে। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়াতে যাচ্ছে।

উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, ইউএনওরা সংবিধান ও উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এবং উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১১ সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করছেন, যা রীতিমতো অপরাধ।

উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ৪ নম্বরে উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘ধারা ৩ এর অধীন ঘোষিত প্রত্যেকটি উপজেলাকে, সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের সহিত পঠিতব্য ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এতদ্দ্বারা প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক একাংশ বলিয়া ঘোষণা করা হইল।’

একই আইনের ৩৩ নম্বরে বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের সচিব হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন।’ আবার উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১১-এর ৩৩-এর (১)-এ ইউএনওকে আরেকটু ক্ষমতাবান করে বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন।’ ৩৩-এর (২)-এ বলা হয়েছে, ‘পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা  নির্ধারিত অন্যান্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করিবেন।’ সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদে ৫৯(১)-এ স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, আইন অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার কথা থাকলেও তিনি কখনো এই পরিচয় ব্যবহার করেন না। আর পরিষদকে সাচিবিক সহযোগিতা করার বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরকারের ১৭টি দফতরকে পরিষদের হাতে ন্যস্ত করার কথা। কিন্তু এতগুলো বছরেও সেই দফতরগুলো পরিষদের কাছে হস্তান্তর হয়নি। ইউএনওরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দফতর থেকে চিঠি পাঠায়, তাতে লেখা থাকে সভাপতিত্ব করবেন ইউএনও। তিনি বলেন, ‘ইউএনওরা পরিষদকে সাচিবিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা আইনে থাকলেও তারা কখনই সেই দায়িত্ব পালন করছেন না। সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছেন তারা। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সরকারের কোনো কার্যক্রমেই ইউএনওরা অন্তর্ভুক্ত করেন না। সবকিছুতেই তারা উপজেলা প্রশাসন উল্লেখ করেন। কোথাও উপজেলা পরিষদ লেখা হয় না। আর ইউএনও উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হলেও কখনই তিনি নিজেকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন না বা লিখেন না। এটা আইনের লঙ্ঘন।’

 

সেলিম আজাদ বলেন, ১৭টি দফতরের সব নথি উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে পাঠানোর নির্দেশনা থাকলেও ইউএনও সেটিও করেন না। তিনি বলেন, ‘যদি আমাদের কোনো কাজই না থাকে তাহলে সরকার কেন আমাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের এতগুলো অর্থের অপচয় হচ্ছে। এই টাকা নষ্ট করার তো দরকার নেই।’ চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই সমস্যা সমাধানে এবং উপজেলাকে কার্যকর স্থানীয় সরকার হিসেবে গড়ে তুলতে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তাকে সংসদে পাস করা আইন মেনে চলতে হবে। উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-সম্পাদক রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ১৯৮৫ সাল থেকে চারবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু এখনকার মতো অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো কাজ নেই। সব কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ইউএনও। চেয়ারম্যান শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। দুর্যোগ এলে আমার কাজ শুধু মিটিং করা।’ তিনি বলেন, পরিষদের সব নথিতে স্বাক্ষর করেন ইউএনও। কোনো নথিই উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে আসে না। পরিষদের কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ইউএনওরা কখনই ‘উপজেলা পরিষদ’ লিখেন না। তারা কোনো চিঠিপত্র ইস্যু করলে লিখেন ‘উপজেলা প্রশাসন’, যা সংবিধান ও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি জানান, নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উপজেলাকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে তারা শিগগিরই রিট করবেন।

উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর উপজেলা আইনের আলোকে এক ছাতাবিশিষ্ট নির্বাচিত প্রশাসনিক স্তরে কাজ করার নির্দেশনা এবং তা প্রতিপালনে কর্মকর্তাদের মানসিকতাই পারে বিরাজমান সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে। উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) অনুযায়ী উপজেলায় থাকা ১৭টি দফতরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কাজ উপজেলায় হস্তান্তরিত। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই ১৭টি বিভাগের যেসব কমিটি করা হয়েছে এর সবগুলোতেই সভাপতি নির্বাহী কর্মকর্তা। আর উপদেষ্টা করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। একইভাবে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হচ্ছেন ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা। অথচ একই প্রজ্ঞাপনে ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আয়ন-ব্যয়ন কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কোনো দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, উল্টো সব ক্ষমতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তারা বলছেন, উপজেলা পর্যায়ে অন্তত ১০০টির বেশি কমিটি রয়েছে, যেগুলোর প্রায় সব কটিতেই সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন হয় ইউএনও, নতুবা তার মনোনীত প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা। কোথায়ও উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানদের রাখা হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান তথা পরিষদের দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম আমিনুজ্জামান বলেন, উপজেলার দুটি চেহারা। একটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার, অন্যটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব। তবে স্থানীয় সরকারের আদেশ-নির্দেশ প্রতিপালন করা হচ্ছে পরিষদের মূল কাজ। তিনি বলেন, সরকার ইউএনওর কোঅর্ডিনেটিং ক্ষমতাকে আরেকটু বাড়িয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করেছে। এর অর্থ হচ্ছে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তথা পরিষদের প্রধান নির্বাহী নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবেন। নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পরিষদের অন্যান্য সরকারি দফতরের কাজ মনিটরিং করবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি (ইউএনও) কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করবেন। ড. আমিনুজ্জামান বলেন, ইউএনও উপজেলা চেয়ারম্যানের ডান হাত হিসেবে কাজ করার কথা। তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা করছেন না। অর্থাৎ চেয়ারম্যান যেসব আদেশ-নির্দেশ দেবেন, সেগুলো প্রতিপালন করাই হচ্ছে সাচিবিক দায়িত্ব। আর যখন কোনো সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো বাস্তবায়নে মনিটরিং করবেন। এটা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কাজ। তিনি বলেন, আইনে সবকিছু যথাযথভাবে বলা হলেও বাস্তবে কার্যকর না হওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় সরকার বা নি¤œস্তরের সরকার কার্যকর না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সাংবিধানিক নির্দেশনা না মানা এবং রাজনৈতিক কমিটমেন্টের অভাব। তিনি বলেন, নিম্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কোনো পাত্তাই দেন না আমলারা। অথচ এটা হওয়ার কথা নয়। উপজেলা পরিষদের কাছেই স্থানীয় প্রশাসন ন্যস্ত থাকার কথা। উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার কথা। কিন্তু আমাদের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনই চান না বলেই নিচের দিকে স্থানীয় সরকার কার্যকর হচ্ছে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর