শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বেপরোয়া সাইবার অপরাধ

বাংলাদেশি অপরাধীদের বিষয়ে অভিযোগ জানাচ্ছে বিদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, করোনায় বেড়েছে অনলাইন হয়রানি

জিন্নাতুন নূর

বেপরোয়া সাইবার অপরাধ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার করে মাত্রাহীন হয়রানি ও সাইবার অপরাধ চলছে। হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউই। নারী, শিশু থেকে শুরু করে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে হয়রানি করছে সাইবার অপরাধীরা। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের মতো মাধ্যমগুলোকে বেপরোয়াভাবে সাইবার অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, সাইবার অপরাধ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ দরকার। সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, সরকারের আইসিটি বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ভয়ঙ্কর এ অপরাধ ঠেকাতে তৎপর আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রামাঞ্চলের সাম্প্রতিক বিচার-শালিসের বড় একটি অংশ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-কেন্দ্রিক। দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে আপত্তিকর ব্যক্তিগত কনটেন্ট শেয়ার করা হচ্ছে, তা অন্যরা দেখে ফেলায় ভুক্তভোগী বিব্রত হন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চাইল্ড পর্নোগ্রাফি গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এরা কিছু ডার্কসাইটের নিবন্ধনকৃত সদস্য ছিলেন। তাদের কিছু ভুয়া ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ছিল যেগুলোয় তারা সমকামী হিসেবে অন্য আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এ ছাড়া তাদের কাছে বিশেষ কিছু ডকুমেন্ট ফাইল ছিল যা ব্যবহার করে তারা কিশোরী মেয়েদের ফুসলিয়ে তাদের কাছ থেকে পর্নোগ্রাফির কনটেন্ট সংগ্রহ করতেন। আর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি সাইটের মালিকদের তারা যদি এসব কনটেন্ট সময়মতো না দিতেন তাহলে তাদেরও নিজস্ব পরিচয় প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। উদ্বেগজনক হলেও বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার ভিকটিম দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও আছে। আমাদের দেশের সাইবার অপরাধীদের বিষয়ে অভিযোগ করে বিদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনও ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাদের অভিভাবকদের কাছে ন্যুড কনটেন্ট পাঠানো হচ্ছে। বিকৃত মানসিকতার লোকজনই এসব করছে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি ও প্রতারিত করার ঘটনা করোনা সমাজে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন প্রতিশোধ নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে যেখানে মানুষ মারামারি করে রাগ কমাত এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেকজনকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে অপরাধী মানসিক তৃপ্তি পায়। সম্প্রতি করোনার কারণে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে গেছে। বর্তমানে অনেকে কাজ হারিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছে। তারাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ এখনো এমন অবস্থানে পৌঁছেনি যেখানে সচেতনতা দিয়েই সাইবার অপরাধের অপরাধ কমানো যাবে। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষকে বিব্রত করার ঘটনা করোনাভাইরাসের মতো সমাজে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা এমন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি যেখানে মান-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই কঠিন। পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া। একটি মেয়েকে আগেও এ সমাজে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে; কিন্তু তা লুকিয়ে করা হলেও এখন প্রকাশ্যেই নারীরা এর শিকার। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সমাজের উঁচু ও নিম্ন শ্রেণির লোকজনের মধ্যে কদর্যতা, পাপাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে সমাজে অনলাইনের মাধ্যমে অন্যায়ের শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনেক উপাদানই আমরা নিতে পারছি না। পাশ্চাত্যের সঙ্গে এক বিপরীতমুখী সমাজব্যবস্থার মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একে বলে ‘কালচারাল ল্যাপ’। ফলে ভিন্ন অপসংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদান আমাদের সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আর এ কারণে এখন অনলাইনে মানুুষকে হয়রানি করার মতো বিভিন্ন অপরাধ সমাজে ঘটতে দেখছি।’ সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনলাইনের হয়রানি প্রতিরোধে সাইবার থানার জন্য আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠিয়েছি। বর্তমানে এটি সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সাইবার অপরাধ দমনে এ ধরনের থানা নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করছি। আশা করছি, সরকার এর অনুমোদনে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবে।’ তিনি বলেন, ‘এখনো যারা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন তারা স্থানীয় থানায় গিয়ে সাহায্য চাইছেন। কিন্তু সাধারণ থানায় কর্মরত সব পুলিশ সদস্য প্রযুক্তিগত বিষয়ে দক্ষ নয়। প্রাথমিকভাবে আমরা একটি সাইবার থানা দিয়ে যাত্রা করছি। পরে দেশের অন্য বিভাগেও সাইবার থানা স্থাপন করা হবে। বর্তমানে আমাদের যে সদস্যরা সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছেন তারা প্রায় সবাই বিদেশে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাইবার থানা করা হলে সেখানে এই প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্যরাই কাজ করবেন।’

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে যে ধরনের সাইবার অপরাধ হচ্ছে সেগুলো মোকাবিলায় আমরা “র‌্যাব সাইবার মনিটরিং সেল” গঠন করেছি। এ সেলের অভিজ্ঞরা ২৪ ঘণ্টা বিভিন্ন ওয়েবসাইট মনিটর করছেন। এভাবে মনিটর করে সম্প্রতি বেশ কিছু অপরাধীকে গ্রেফতারেও সক্ষম হয়েছি।’ তার মতে, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ার কারণেই এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে। তিনি আরও জানান, র‌্যাব সদর দফতরের নির্দেশনায় ১৫টি ব্যাটালিয়নে মনিটরিং টিমের সদস্যরা কাজ করছেন। অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান ‘আই পে সিস্টেম লিমিটেড’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারী ও শিশুদের আমাদের দেশে সামাজিকভাবে হেয় করা সহজ। অনলাইনে পুরুষ ও ছেলেদের তুলনায় নারী-শিশুকে আক্রমণ করাও সহজ। বিশেষ করে ডিজিটাল মিডিয়ায় এটি আরও সহজ হয়ে গেছে। কারণ, এর টুলগুলো এখন সহজলভ্য। আগে শত্রুতাবশত সমাজে একজন আরেকজনকে হেয় করে প্রতিশোধ নিত। ডিজিটাল মিডিয়ায় সে কাজটি আরও সহজ হয়ে পড়ায় সাইবার অপরাধ বেড়েছে।’ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, ‘একজনকে যখন কেউ কোনোভাবে নির্যাতন করতে চায় তখন কোনো না কোনো মিডিয়ার প্রয়োজন হয়। আর এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া এখন জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এর মাধ্যমে অপরাধী তার নিজের পরিচয়ও গোপন রাখতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন অপরাধী তার স্বার্থ হাসিলের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে অন্যকে বিব্রত করে। বেশির ভাগ অপরাধীকেই মানসিকভাবে অসুস্থ মনে করার কোনো কারণ নেই।’ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ডিজিটাল ফরেনসিক টিমের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘সোশ্যাল প্ল্যাটফরমের যে আপত্তিকর পোস্টগুলো ভাইরাল হচ্ছে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, একটা বড় অংশই ভুক্তভোগী হচ্ছে শুধু ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার কারণে। একটি সোশ্যাল প্ল্যাটফরম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাইরের দেশে যে নীতি ও নৈতিকতা ব্যবহার করা হয় আমাদের দেশে তা করা হয় না। আমাদের কাজের অংশ হিসেবে আমরা স্কুল-কলেজে এ বিষয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করে থাকি। আবার তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে ছেলেমেয়েরা যেহেতু সবাই ডিভাইস দ্বারা সংযুক্ত এজন্য এসব ডিভাইস তারা কী কাজে ব্যবহার করছে তা নজরদারি করতে হবে এবং তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি একটি টাইম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে আনতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর