বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

রিমান্ডে ইরফান সেলিম ও দেহরক্ষী

নৌ কর্মকর্তাকে মারধর মামলা ডিবিতে, চকবাজার থানায় আরও ৪ মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রিমান্ডে ইরফান সেলিম ও দেহরক্ষী

রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ইরফান সেলিম ও দেহরক্ষী জাহিদুলকে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের মামলায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বরখাস্ত কাউন্সিলর মো. ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদুল মোল্লা ওরফে জাহিদকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর এ আদেশ দেন। অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে চকবাজার থানায় পৃথক দুটি করে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায়  দায়ের করা মামলা তদন্তের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগে (ডিবি)।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (রমনা) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ‘ধানমন্ডি থানায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তার দায়ের করা মামলাটির তদন্তভার আমাদের কাছে এসেছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে।’

পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল পৌনে ১০টায় কারাগার থেকে দুই আসামি ইরফান সেলিম ও জাহিদকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাদের কারাগারের গারদে রাখা হয়। এরপর বেলা ১২টায় ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূরের আদালত দুই আসামিকে ধানমন্ডি থানার মামলায় গ্রেফতার দেখান। তারপর একই আদালতে দুই আসামির রিমান্ড শুনানি হয়। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করে। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত দুই আসামির প্রত্যেকের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর আগে মঙ্গলবার ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশফাক রাজীব হায়দার আসামি ইরফান সেলিম ও জাহিদকে গ্রেফতার দেখানোসহ সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। আদালত আসামিদের উপস্থিতিতে গ্রেফতার দেখানোর বিষয়ে শুনানির জন্য বুধবার (গতকাল) দিন ধার্য করেন।

আদালতে শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘আসামিরা নিরীহ ব্যক্তিকে কেন এভাবে মারধর করল। আসামিদের রিমান্ডে নিলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিও আছে। তাদের পরিচয় জানতেও দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’

অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে আইনজীবী প্রাণনাথ রিমান্ডের বিরোধিতা করে বলেন, ‘ইরফান যে বাদীকে মেরেছেন, এমন কথা এজাহারে বলা নেই। বাদীকে কে না কে মেরেছে সেটা সুনির্দিষ্ট নয়।’ তিনি যোগ করেন, ‘বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বাসায় গেল। সব দেখে তাকে গ্রেফতার করল, সাজাও দিল, যা কিছু আছে, যা নেই, তাসহ সাজা হলো। মারামারির জন্য রিমান্ডের কী দরকার। প্রমাণ হলে সাজা হবে, না হলে খালাস পাবে। এখানে রিমান্ডের কিছু নেই।’

উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক দুই আসামিকে তিন দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। এ মামলার আরেক আসামি এ বি সিদ্দিক দীপুকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকেও তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। আর এর আগের দিন ইরফানের গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে এক দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত।

চার মামলা তদন্তের নির্দেশ : এদিকে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি করে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল অস্ত্র আইনে করা দুটি মামলার এজাহার আদালতের পৌঁছালে ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী তা গ্রহণ করে ১৭ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুটি মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ এজাহার গ্রহণ করে ৩ ডিসেম্বর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

চকবাজার থানাসূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে চকবাজার থানায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে এ চারটি মামলা করা হয়। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনার জেরে সোমবার ঢাকার সোয়ারীঘাটের দেবীদাস ঘাট লেনে এমপি হাজী সেলিমের বাড়িতে দিনভর অভিযান চালানোর সময় তল্লাশি করে আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক ও ওয়াকিটকি পাওয়া যায় বলে জানানো হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। ইরফানের কাছ থেকে অবৈধ পিস্তল ও এয়ারগান উদ্ধারের ঘটনায় অস্ত্র আইনে এবং কয়েক বোতল মদ পাওয়ায় মাদক আইনে পৃথক মামলা হয়েছে। একইভাবে জাহিদের কাছ থেকে অবৈধ পিস্তল উদ্ধারের অভিযোগে অস্ত্র আইনে এবং ৪০৬ পিস ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগে মাদক আইনে মামলা করা হয়েছে।

ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েই চলছিল গাড়িটি : রবিবার রাতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছিল ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৫৭৩৬ নম্বরের গাড়িটি। এরপর ওই গাড়ি থেকে কয়েকজন নেমে ওয়াসিফকে মারধর করেন বলে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে। তখন ওই গাড়িতে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ছিলেন। যে গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর করা হয়েছিল, সে গাড়ির ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ নেই। তবে ‘সংসদ সদস্য’ স্টিকার নিয়ে গাড়িটি রাস্তায় চলাচল করছিল নিয়মিত।

যানবাহনের নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদ দেওয়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো ব্রিটিশ ব্র্যান্ড ল্যান্ড রোভার গাড়িটির ইঞ্জিনক্ষমতা ২৪৯৫ সিসি। এটি প্রথমে ইউরোপের একটি দেশের দূতাবাসের জন্য আনা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে দূতাবাস গাড়িটি নিলামে তুললে অটোটেক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার জন্য আনা গাড়ি শুল্কমুক্ত। তবে বাংলাদেশে গাড়িটি বিক্রি করে দেওয়ায় ক্রেতাকে নিবন্ধনের সময় পুরো শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ২০০৫ সালে গাড়িটির মালিকানা বদল করা হয়। তবে ২০১০ সাল থেকে এ গাড়ির ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করা নেই। ২০০৫ সাল থেকে রোড ট্যাক্সও দেওয়া হয়নি। বর্তমানে এই শ্রেণির গাড়ির রোড ট্যাক্স বছরে ৭৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া রয়েছে প্রতি বছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদের ফি। ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ না থাকলে নির্ধারিত হারে জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৫ সালে গাড়িটির মালিকানা বদলের পর মালিক বিআরটিএর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গাড়িটি ধানমন্ডি থানায় আটক আছে।

চার মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে : মঙ্গলবার রাত ১২টার পর চকবাজার থানায় র‌্যাবের ডিএডি মো. কাইয়ুম ইসলাম অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ইরফান ও জাহিদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে চারটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে কাইয়ুম ইসলাম উল্লেখ করেন, সোমবার সকালে তারা ১০ জন বিশেষ অভিযান পরিচালনার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তিনি জানতে পারেন চকবাজারের দেবীদাস ঘাট লেনের ২৬ নম্বর বাসা ‘চান সর্দার দাদাবাড়ি’তে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ কয়েকজন ব্যক্তি অবস্থান করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ফোর্সসহ তখনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে রওনা দেন তিনি। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুজন দৌড়ে ভবনের ওপরের দিকে উঠে যায়। তখন তারা ভবনটিকে ঘেরাও করে ফেলেন। পরে চারজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে র‌্যাব তল্লাশি চালায়। ভবনের চতুর্থ তলায় দরজার ডান দিকে পশ্চিম দিকের ঘরে মো. জাহিদুল মোল্লাকে পান তারা। এজাহারে র‌্যাব লিখেছে, জাহিদুল মোল্লার দেহ তল্লাশির সময় কালো রঙের বিদেশি পিস্তল এবং সাদা রঙের জিপারযুক্ত স্বচ্ছ এয়ারটাইট পলিপ্যাক থেকে ২০৩টি করে ৪০৬ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আর দুই পকেট থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি ‘টাচ মোবাইল’। ওই ভবনেরই চতুর্থ তলার অন্য পাশে পাওয়া যায় মো. ইরফান সেলিমকে। তার ব্যক্তিগত বিছানার তোশকের ডানপাশের নিচ থেকে পাওয়া যায় পিস্তল। জাহিদুল মোল্লা ও ইরফান সেলিম দুজনের পিস্তল একই ব্র্যান্ডের। জাহিদুলের জিম্মা থেকে উদ্ধার বিদেশি পিস্তলটি কালো রঙের। ব্যারেলের একদিকে ইংরেজি হরফে লেখা মেইড ইন ইউএসএ, অন্যদিকে লেখা অটো পিস্তল। পিস্তলের ওপরে লেখা আর্মি। পিস্তলটির ব্যারেলের দৈর্ঘ্য ৬ ইঞ্চি। বাঁট সাদা রঙের। বাঁটের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৭ ইঞ্চি। দুই রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন ছিল এতে। প্রতিটি গুলির গায়ে ইংরেজিতে লেখা কেএফ এবং ৭.৬৫। ইরফান সেলিমের কাছ থেকে পাওয়া গুলি ও ম্যাগাজিনের সংখ্যাও এক। এগুলোতেও ইংরেজিতে লেখা কেএফ এবং ৭.৬৫। জব্দ তালিকায় এয়ারগান, কালো রঙের দুটি ছোরা, চাইনিজ কুড়াল, ৩৮টি কালো রঙের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ব্যাটারি, চার্জারসহ ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফসহ ব্রিফকেস, একটি ক্যামেরাযুক্ত ড্রোন, বিয়ার ও মদের কথা উল্লেখ আছে। র‌্যাব লিখেছে, অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও মাদক বিষয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসা করলেও সন্তোষজনক জবাব কিংবা কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। এসব মামলার বিষয়ে র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান বলেন, আধিপত্য বিস্তারের কাজে ওয়াকিটকি ব্যবহার করতেন ইরফান। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন তিনি। তার বাড়ি থেকে বিদেশি মদসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে দুটি করে মোট চারটি মামলা করেছে। অস্ত্র আইনে দুটি এবং মাদক আইনে দুটি মামলা কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অস্ত্র ও মাদকগুলো আলাদা স্থান থেকে উদ্ধার করার কারণে পৃথক মামলা হয়েছে। এদিকে র‌্যাবের দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায়ও ইরফান ও জাহিদকে সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার।

সর্বশেষ খবর