সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রবাসফেরত নারীদের যত কষ্ট

জিন্নাতুন নূর

করোনা মহামারীর কারণে সংকটে পড়েছেন বেশির ভাগ বিদেশফেরত নারী। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা নারীরা মহামারীর কারণে বকেয়া বেতন নিয়ে দেশে আসতে পারেননি। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এই নারীদের সঙ্গে ‘মজুরি চুরি’র ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অনেক নারী শ্রমিক আগের তুলনায় কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, চলতি বছরের এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে অক্টোবরের ৭ তারিখ পর্যন্ত ১৮টি দেশ থেকে ১৮ হাজার ৭৬৩ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র সৌদি আরব, ওমান, জর্ডান, লেবানন, আরব আমিরাত ও কুয়েতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটি গবেষণা করেন। এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, মহামারীর কারণে নারী শ্রমিকদের কাজের চাপ আগের তুলনায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে। এতে আরও বলা হয় এই সময় অনেক শ্রমিককে নিয়মিত বেতনও দেওয়া হয়নি। ৭৬ শতাংশ শ্রমিক যারা মহামারীর সময় দেশে ফিরেছেন তারা পুরো বেতন পাননি। আবার মাত্র ২২ শতাংশ শ্রমিক জানান, তারা নিয়মিত খাবার খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই কয়েক মাসে দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৬ হাজার ৬৪৫ জন সৌদি আরব থেকে এসেছেন। এ ছাড়া আরব-আমিরাত থেকে ৩ হাজার ৫৩৩, লেবানন থেকে ২ হাজার ১৫৫, জর্ডান থেকে ১ হাজার ৭৮৯, কাতার থেকে ১ হাজার ৬০১, ওমান থেকে ১ হাজার ২৯০, তুরস্ক থেকে ৫৭৩, মালয়েশিয়া থেকে ৩৮৯, মরিশাস থেকে ৩১২, কুয়েত থেকে ২১৯, মালদ্বীপ থেকে ৭৭, ইরাক থেকে ৬০, সিঙ্গাপুর থেকে ২৯, বাহরাইন থেকে ৪৮, নেপাল থেকে ১৫, ইউকে থেকে ১৩, থাইল্যান্ড থেকে ১১ এবং হংকং থেকে ফিরেছেন চারজন নারী শ্রমিক। জানা যায়, মহামারীতে শ্রমিক ছাঁটাই ও কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এই শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী শ্রমিককে তার মালিক দেশে ফিরে আসার সময় পূর্ণ বেতন দেননি। ফলে দেশে ফিরে এই শ্রমিকরা অর্থ সংকটের মধ্যে পড়েছেন। নারী শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত থাকায় তারা আগের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কারণ লকডাউনে পারিবারিক নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ায় এর প্রভাব নারী গৃহ শ্রমিকদের ওপরও পড়ছে। করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে করা এক জরিপে জানা যায়, মহামারীর কারণে দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের ৮৭ শতাংশেরই আয়ের কোনো উৎস নেই। ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন তারা প্রচ- দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। ৩৪ শতাংশ জানান, তাদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই। ৯১ শতাংশ জানান, তারা সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা পাননি। অনেকেই আবার ফ্রি ভিসায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। ফলে তাদের কোনো নিয়োগকর্তা নেই। অন্যদিকে লকডাউন থাকার ফলে ভিসা নবায়ন করতে না পেরে খালি হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে যারা ঋণ নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন তারা পড়েছেন ভয়াবহ চাপে। গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. তাসনিম সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনায় যে নারী শ্রমিকরা ফিরে এসেছেন তাদের অর্থনৈতিক ও মানসিক রিইন্ট্রিগ্রেশন করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট এনজিওর সঙ্গে পার্টনারশিপে এই পরিস্থিতিতে যারা ফিরে আসছেন তাদের চিহ্নিত করে মানসিক সহায়তা প্রদান করা। যেহেতু নারী শ্রমিকরা বেশিরভাগই বৈধ পথে বিদেশে গিয়েছেন, এ জন্য সরকারের নারী শ্রমিকদের উদ্দেশে ঘোষণা দিতে হবে।

যার যা বেতন পাওনা আছে তা নিয়ে নিয়োগকর্তার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। নারী শ্রমিকদের সরকার যে ঋণ দিতে চাচ্ছে তা কেউ নিতে চাচ্ছে না। এদের সৃজনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আছে সেখানে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এনজিওগুলোও এই নারীদের প্রশিক্ষণের কাজে লাগাতে পারে। প্রসঙ্গত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজার ৪১৩ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, লেবানন, জর্ডান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউকে, হংকং, মরিশাসসহ বিভিন্ন দেশে যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যান ১০ হাজার ৯০৩ জন সৌদি আরবে। এ ছাড়াও ওমানে যান ২ হাজার ৯২৮ এবং জর্ডানে যান ২ হাজার ৯৬৭ জন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর