সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

গুজব ছড়িয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পাঁচজন গ্রেফতার

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে শহিদুন্নবী জুয়েল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় করা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শনিবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন লালমনিরহাট পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা। এদিকে  ঘটনার দিন আসলে কী ঘটেছিল এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গতকাল সকালে বুড়িমারী স্থলবন্দরে আসেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক আল মাহমুদ ফাউজুল কবিরসহ তিন সদস্যের একটি কমিটি। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এ হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়া এলাকার আবদুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাতো ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার এসআই শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা করেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শনিবার পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন শরিফুল ইসলাম শরীফ (২৪), আশরাফুল ইসলাম (৩২), বায়েজিদ হোসেন (২২), রফিকুল ইসলাম রফিক (১৯) ও মাসুম মিয়া (৩২)। গ্রেফতার ব্যক্তিরা সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা। গ্রেফতার সব আসামিকে গতকাল আদালতে প্রেরণ করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন লালমনিরহাট পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা। এদিকে তদন্ত কমিটি বুড়িমারী জামে মসজিদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পুড়িয়ে ফেলার স্থানসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করে।

গুজবে কান না দিতে সবার প্রতি সরকারের অনুরোধ : গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে গুজবে কান না দিতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। গতকাল রাতে এক তথ্য বিবরণীতে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘কোনো ধরনের গুজব বা উস্কানিমূলক বক্তব্যে কান না দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব সৃষ্টিকারী সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলে তা অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার বদ্ধপরিকর’।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে একজনকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হল।

কমিটির প্রধান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক আল মাহমুদ ফাউজুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিহত জুয়েল কেন বুড়িমারীতে এলেন? তাকে যখন মারধর করা হচ্ছে তখন তার সঙ্গে থাকা অপর লোকটি তাকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন কিনা? আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি তাকে হঠাৎ করে কেন মারধর করলেন? নিহত জুয়েল কোরআন অবমাননা করেছেন কিনা? ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হাফিজুল নিহত জুয়েলকে অন্য স্থানে না সরিয়ে দীর্ঘক্ষণ পরিষদে আটকে রাখলেন কেন? অনেক পরে কী কারণে পুলিশকে খবর দেওয়া হলো? বহিরাগত লোকজন কার ডাকে এলেন? এ ঘটনায় কারও ইন্ধন আছে কিনা?’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যতটুকু তদন্ত করা হয়েছে, তাতে নিহত যুবক কোরআন অবমাননা করেছেন এ বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

আল মাহমুদ ফাউজুল কবির বলেন, কমিশন তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি এম রাহসিন কবির, সিনিয়ন সহকারী পুলিশ সুপার তাপস সরকার উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল বৃহস্পতিবার বিকালে সুলতান যোবাইয়ের আবদার নামে একজন সঙ্গীসহ বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকালে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানশেডে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে পড়ে যায়। এ সময় সেগুলো তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথাকাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান যোবাইয়েরকে পাশের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হন। রাতে পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর