মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

হোয়াইট হাউস কার

আজ আমেরিকার নির্বাচন, বাইডেন না ট্রাম্প- কে হচ্ছেন শক্তিধর প্রেসিডেন্ট

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

হোয়াইট হাউস কার

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের লড়াই আজ। যুক্তরাষ্ট্রে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ভোটার অংশ নেবে এ নির্বাচনে। এ নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্ধারণ হবে হোয়াইট হাউসের চাবি কার হাতে যাবে। ধনকুবের থেকে রাজনীতিতে এসে বিশ্ব কাঁপানো রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নাকি ডেমোক্র্যাট পার্টির আশা জাগানো প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট পদে বসবেন- তা ঠিক করবে আমেরিকানরা। হাতি ও গাধা প্রতীকের এ লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে পুরো বিশ্বই।

২৪ কোটি ভোটারের এ নির্বাচনের জন্য সারা আমেরিকায় আড়াই লক্ষাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ইউএস ইলেকশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাবলিক স্কুল, চার্চ, গির্জা, কমিউনিটি সেন্টার প্রভৃতি স্থানে ভোট গ্রহণ করা হবে। সকাল ৬টা থেকে সময়ভেদে রাত ১০টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা হবে। এবারের নির্বাচনেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় ব্যালট ছাপা হয়েছে বাংলায়। ভোট কেন্দ্রে থাকবেন বাঙালি অনুবাদক। অনেক কেন্দ্রের বাইরে বাংলায় সাইনও থাকবে। উল্লেখ্য, অফিস, ব্যাংক সবকিছুই খোলা থাকে নির্বাচনের দিন। তবে যেসব স্কুলে কেন্দ্র স্থাপন হয়, সেগুলোয় সাধারণত ক্লাস সাসপেন্ড থাকে। এবারে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ছাড়াও একই ব্যালটে ইউএস সিনেটের ৩৫ আসনের প্রার্থীদের নামও থাকবে। আরও থাকবে হাউসের ৪৩৫ প্রার্থীর নাম। শুধু তাই নয়, ১১ স্টেট, ২ টেরিটরির প্রার্থীরাও ভোটে থাকবেন। বেশ কটি স্টেট পার্লামেন্টের ভোটও হবে ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার। প্রেসিডেন্ট পদে ভোটাররা ভোট দিয়ে মূলত ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচন করবেন। ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজের ২৭০ ভোট পেতে হবে বিজয়ের জন্য। এ জন্য দোদুল্যমান স্টেটসমূহে চষে বেড়াচ্ছেন ট্রাম্প ও বাইডেন। সর্বশেষ অবজারভেশন অনুযায়ী পেনসিলভেনিয়ায় যিনি জয়ী হবেন তার ভাগ্যেই জুটবে হোয়াইট হাউসে পরবর্তী চার বছর অবস্থানের চাবি। তবে ইউএস সিনেট ও হাউসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ডেমোক্র্যাটরা পাবেন বলে সবার ধারণা। ভোটের ময়দানে যে জাগরণ ঘটেছে তা ডেমোক্র্যাটদের বিজয় ত্বরান্বিত করবে অর্থাৎ পরিবর্তনের যে বাতাস বইছে তার সুফল ট্রাম্পের লাগামহীন মিথ্যাচার এবং অ-আমেরিকান কর্মকা-ের যবনিকাপাত ঘটানোর জন্য যথেষ্ট বলেও মন্তব্য করছেন সুধীজন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সর্বশেষ ট্রাম্পের শীর্ষস্থানীয় এক উপদেষ্টা গত শুক্রবার বলেছেন, পুনরায় ট্রাম্প জয়ী হলে আগামী চার বছরের জন্য পারিবারিক কোটাসহ অভিবাসনের অধিকাংশ কার্যক্রম স্থগিত রাখা হবে। মুসলিম ব্যানের তালিকায় যুক্ত হবে আরও কটি দেশ। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগাম ভোটের মাত্রা আশাতীত হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যে ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা এখন দূর হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, করোনা মহামারীর কারণে ভোটাধিকার প্রদানের আগ্রহ অধিকাংশ আমেরিকানেরই কমবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটতে যাচ্ছে তার একেবারেই উল্টো।

যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৪ বছরের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বেশি আগাম ভোট পড়েছে ৯ কোটি ৩০ লাখ। গত চার বছর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ-আমেরিকান ও অনৈতিক কর্মকান্ড/মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে অসন্তুষ্ট আমেরিকানরা ব্যালট বিপ্লবে এহেন শাসনের অবসান ঘটানোর সংকল্প থেকেই ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন। করোনাভাইরাস নিয়ে লাগাতার তামাশা এবং মানুষের মৃত্যু নিয়ে হাসিঠাট্টাকেও অসহায় মানুষ সহজভাবে নেয়নি। বিশেষ করে একের পর এক মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, ছলচাতুরী, সর্বশেষ ভোটারের রায়কে অসম্মান প্রদর্শনের ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য ট্রাম্পকে অপছন্দের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিণত করেছে অধিকাংশ ভোটারের কাছে- এমন অভিমত প্রকাশিত হয়েছে সর্বশেষ জরিপে। নির্বাচনে প্রাথমিক দৃষ্টিতেই বিজয়ী হচ্ছেন বলে মনে না করলেও অন্ধ সমর্থকদের দিয়ে ‘অনুগত গণমাধ্যম’-এ ট্রাম্প পুনরায় জয়ী হয়েছেন ঘোষণা প্রদানের ষড়যন্ত্র এবং ভোট গণনার প্রাক্কালে বিভিন্ন স্থানে গোলযোগ বাধানোর হুঙ্কার প্রদানের ঘটনাবলিতে অতিষ্ঠ বিবেকসম্পন্ন ভোটাররা। রবিবার পর্যন্ত আগাম ভোট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণকারীরা এসব অভিমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করছেন, ৩ নভেম্বর রাত ১০টার মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যাবে প্রেসিডেন্ট পদে জয়-পরাজয়ের ঘটনা। কারণ মূল নির্বাচনের দিনও বিপুলসংখ্যক ভোটারের সমাগম ঘটবে করোনার তা-ব সত্ত্বেও। তাই ডাকযোগে আসা ভোটের সামান্য অংশ গণনার বাইরে থাকলেও ফলাফলে তা কোনো প্রভাব ফেলবে বলে কেউই মনে করছেন না। আর এভাবেই রিপাবলিকান ট্রাম্পের হুমকি-ধমকির অবসান ঘটবে এবং প্রকৃত অর্থেই বিজয়ী হবে আমেরিকার গণতন্ত্র। এ আশায় বুক বেঁধে রয়েছে সচেতন ও করোনায় সন্ত্রস্ত আমেরিকানরা। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালের নির্বাচনে যত ভোট পড়েছিল, তার চেয়ে ১১০.৬ % বেশি পড়েছে হাওয়াই স্টেটে। ১০৭.৭ % বেশি পড়েছে টেক্সাসে। এ দুটি স্থানেই ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনের পক্ষে বেশি ভোট পড়েছে বলে পর্যবেক্ষণ জরিপে উদ্ঘাটিত হয়। অন্য স্টেটের মধ্যে ২০১৬ সালের মোট ভোটের ৯৫.৮ % পড়েছে মন্টানা, ওয়াশিংটনে ৯৩.৮ %, নিউ মেক্সিকোয় ৯৩.২ %, জর্জিয়ায় ৯৩.২ %, নর্থ ক্যারলিনায় ৯১.১ %, টেনেসিতে ৮৯.৬ %, নেভাদায় ৮৮ %, ওরেগনে ৮৭.৮ %, ফ্লোরিডায় ৮৬.৬ %, আরিজোনায় ৮৬.৫ % এবং কলোরাডোয় ৮৩.৭ %। ব্যাটেলগ্রাউন্ডের অন্যতম পেনসিলভেনিয়া স্টেটে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৪.৩ %। উল্লেখ্য, এ স্টেটে এই প্রথম যে কেউ ডাকযোগে ব্যালট সংগ্রহ ও প্রেরণ করলেন বলে আগাম ভোটের সংখ্যা অন্য স্টেটের চেয়ে কম। এর আগের নির্বাচনে ৫ %-এর বেশি অনুপস্থিত ভোটাররা ডাকযোগে ব্যালট পাঠাননি। ব্যাটেলগ্রাউন্ড স্টেটসমূহের মধ্যে উইসকনসিনে ৬২.৩ %, আইওয়ায় ৫৬ %, মিশিগানে ৫২.৮ % এবং ওহাইয়োতে ৪৮.৮ % ভোট পড়েছে রবিবার পর্যন্ত।

ইতিপূর্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটের পরিসংখ্যান : ২০০৮ : বারাক ওবামা বনাম জন ম্যাককেইন- ৬১.৬৫ %, ২০১৬ : ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম হিলারি ক্লিনটন- ৬০.১ %, ২০০৪ : জর্জ ডব্লিউ বুশ বনাম জন কেরি- ৬০.১ %, ২০১২ : বারাক ওবামা বনাম মিট রমনি- ৫৮.৬ %, ১৯৯২ : বিল ক্লিনটন বনাম জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ- ৫৮.১ %, ১৯৭২ : রিচার্ড নিক্সন বনাম জর্জ ম্যাকগভার্ন- ৫৬.২ %, ১৯৮৪ : রোনাল্ড রিগ্যান বনাম ওয়াল্টার মনডেল- ৫৫.২ %, ১৯৭৬ : জিমি কার্টার বনাম জেরাল্ড ফোর্ড- ৫৪.৮ %, ১৯৮০ : রোনাল্ড রিগ্যান বনাম জিমি কার্টার- ৫৪.২ %. ২০০০ : জর্জ ডব্লিউ বুশ বনাম আল গোর- ৫৪.২ %, ১৯৮৮ : জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ বনাম মাইকেল ডুকাকিস- ৫২.৮ %, ১৯৯৬ : বিল ক্লিনটন বনাম বব ডোল- ৫১.৭ %।

শেষ মুহূর্তের প্রচারণা : গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফ্লোরিডায় জয়ী হওয়ায় বসতি জন্মস্থান নিউইয়র্ক থেকে সরিয়ে সেখানে নিয়ে গেছেন। কারণ, নিউইয়র্কে কখনই তিনি জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখেননি। তবে এবার সেই ফ্লোরিডায়ও ঘাঁটি গেড়েছেন জো বাইডেন। বিভিন্ন জরিপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস আসছে। একই অবস্থা পেনসিলভেনিয়ায়ও। ট্রাম্পের ধারণা, পেনসিলভেনিয়ায় জিততে পারলে তার বিজয় কেউই ঠেকাতে পারবে না। এ জন্য প্রায় দিনই ট্রাম্প অথবা তার ঘনিষ্ঠজনেরা পেনসিলভেনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইডেনও এ স্টেটে আসছেন ঘন ঘন। এমনকি বাইডেনের পক্ষে বারাক ওবামাও কয়েকবার সমাবেশ করেছেন পেনসিলভেনিয়ায়। ট্রাম্পের সমর্থকদের হুমকি অনুযায়ী যদি কোনো অঘটন না ঘটে তবে বিপুল ভোটেই বাইডেন বিজয়ী হবেন বলে সর্বশেষ বিভিন্ন জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টিতে নবাগত এবং ট্রাম্পের অন্ধভক্তরা গত কদিনে বাইডেনের নির্বাচনী কর্মকা-ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে প্রশাসনেও স্বস্তি নেই। ইতিমধ্যে বড় বড় শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। লোকজনকে সাবধানে চলাচলের আহ্বান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ এক ধরনের উত্তেজনা আর অস্বস্তি বিরাজ করছে নির্বাচন ঘিরে। স্মরণকালের আর কোনো নির্বাচনে এমন পরিস্থিতির অবতারণা কখনো হয়নি। উল্লেখ্য, করোনার সংক্রমণ পুনরায় ব্যাপকভাবে শুরু হলেও ট্রাম্প এবং তার সমর্থকের বড় একটি অংশ এখনো মাস্ক পরিধান করেন না। যেসব স্থানে ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশ হচ্ছে সেখানেই সংক্রমণের হার বেড়েছে বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করলেও ন্যূনতম মাথাব্যাথা নেই ট্রাম্প ও তার লোকজনদের। অর্থাৎ জনসাধারণকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলেই নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প- এমন অভিযোগ শীর্ষস্থানীয় সব গণমাধ্যমে ক্যাটাগরিকেলি করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর