বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ফলাফলের অপেক্ষায় উৎকণ্ঠা

সর্বশেষ সব জরিপে বাইডেন এগিয়ে, একগুঁয়েমিতে ট্রাম্প, আগাম ভোট গণনায় সময় লাগবে কয়েক দিন

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

ফলাফলের অপেক্ষায় উৎকণ্ঠা

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি ভোটকেন্দ্র -এএফপি

সোমবার অপরাহ্ণ তথা নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি আমেরিকান ভোট প্রদান করেছেন। প্রবাসীদের ৮০% আগাম ভোট দিয়েছেন বলে কমিউনিটি সূত্রে বলা হয়। করোনার আতঙ্কে কেউই ভিড় ঠেলে মঙ্গলবার কেন্দ্রে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করায় আগাম ভোট দেন তারা। আগাম ভোটের মধ্যে ৬ কোটি ২৫ লাখ ডাকযোগে এবং অবশিষ্ট ৩ কোটি ৭৫ লাখ আমেরিকান সশরীরে আগাম ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট স্ক্যান করেছেন। সারা আমেরিকায় ভোটের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কর্মরত দল-নিরপেক্ষ ওয়েবসাইট ‘ইউএস ইলেকশন্স প্রজেক্ট’র অধিকর্তা ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার অধ্যাপক মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড সোমবার রাতে এ তথ্য জানান। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের নির্বাচনে ১৩ কোটি ৯০ লাখ আমেরিকান ভোট দিয়েছিলেন। এবার সে সংখ্যা ছাড়িয়ে ১৬ কোটির কাছে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে গণহারে আগাম ভোটের প্রবর্তন          করার পাশাপাশি ডাকযোগে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করার সুফল হিসেবে রেকর্ডসংখ্যক ভোটার এবারের নির্বাচনে অংশ নিলেন। এর ফলে মঙ্গলবার রাত ১০টার মধ্যে ভোট গ্রহণের সময়সীমা অতিবাহিত হলেও ফলাফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে বেশ কদিন। ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় লাগবে এ সময়।

নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেছেন, ৫০টির মধ্যে মাত্র ৯ স্টেটের ৯৮% রেজাল্ট বুধবার দুপুরের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসি এবং আরও ২২টি স্টেটের ব্যালট ডাকযোগে ৪ নভেম্বর (বুধবার) পর্যন্ত পাওয়া গেলেও সেগুলো গণনায় আসবে। তাই রেজাল্টের জন্য অপেক্ষার সময় বাড়বে। নিউইয়র্ক এবং আলাস্কা স্টেট কখনই ডাকযোগে আসা ব্যালটের গণনা নির্বাচনের দিন রাতে সম্পন্ন করতে পারে না। রোড আইল্যান্ডেরও একই অবস্থা। দোদুল্যমান পেনসিলভেনিয়া এবং মিশিগান স্টেটের নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান, পূর্ণাঙ্গ ফলাফল জানতে কদিন অপেক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য, ২৩ স্টেটের বিপুলসংখ্যক ভোটার ডাকযোগে ব্যালটের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা মত পাল্টিয়ে সশরীরে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব ভোটারকে প্রভিশনাল ব্যালট সংগ্রহ করতে হবে। আর এসব ব্যালট গণনায় তখনই আসবে, যদি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যালট গণনার পর দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান খুব বেশি হয়। তেমন পরিস্থিতির অবতারণা হলে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষার সময় দীর্ঘতর হতে বাধ্য। কারণ, ডাকযোগে সংগ্রহ করা ব্যালটগুলো পোস্ট করা হয়েছে কিনা কিংবা তারা যে বিবরণ দিয়ে ব্যালট সংগ্রহ করেছেন তা সঠিক কিনা-বিস্তারিতভাবে তা খতিয়ে দেখবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আগাম ভোটে ডেমোক্র্যাট বাইডেন এগিয়ে থাকলেও কেন্দ্রে এসে ৩ নভেম্বর (মঙ্গলবার) ভোট প্রদানকারীর মধ্যে রিপাবলিকান ট্রাম্পের সমর্থক অনেক বেশি। এ জন্য ট্রাম্প চাচ্ছেন যে কোনো উপায়ে নির্বাচনের দিনই ফলাফল ঘোষণা করাতে। এ জন্য রিপাবলিকানরা নানা কৌশলে এগোচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় কারচুপি এবং ভোট-জালিয়াতির আশঙ্কা আগে থেকেই জোরালোভাবে করে আসছেন ট্রাম্প। ডেমোক্র্যাটরা সবসময়ই নাকি ডাকযোগে ভোটে কারচুপি করে বলেও অভিযোগ রয়েছে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। যদিও বিগত কয়েক দশকের নির্বাচনে ডাকযোগে কখনই কারচুপির ঘটনা ছিল না বলে ফেডারেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিগত নির্বাচনগুলোর আলোকে অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন-এই ৮টি স্টেটকে বলা হয় স্যুয়িং স্টেট অর্থাৎ এসবের ভোটারের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করে। গত নির্বাচনে উইসকনসিন, মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়ায় জয় পেয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারের সর্বশেষ জরিপে গড়পরতা সমান অবস্থানে রয়েছেন বাইডেন ও ট্রাম্প। জর্জিয়া, পেনসিলভেনিয়া, মিশিগান, অ্যারিজোনায় বাইডেন বিজয়ী হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বিরাটসংখ্যক ভোটার এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সিংহভাগ বাইডেনকে ভোট দিচ্ছেন বলে বিভিন্ন অবজার্ভেশনে উঠে এসেছে। গত নির্বাচনে নারী হিসেবে এবং আরও কিছু কারণে হিলারিকে ভোট দেননি অনেক কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্র্যাট। তারা এবার বাইডেনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন আগে থেকেই। ফ্লোরিডায় বাইডেন এগিয়ে থাকলেও গত কদিনে সে ধারায় পরিবর্তন এসেছে। কারণ, ট্রাম্প নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। এ দাবিতে তিনি ভোটারের হৃদয়ে ভিন্ন একটি স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন বলে সর্বশেষ জরিপে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ইলেক্টোরাল ভোটে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবেন-তা নিশ্চিত করে কেউই এখন আর বলছেন না। তবে করোনাভাইরাস রোধে চরম ব্যর্থতার পরিচয় এবং লাগাতার মিথ্যাচার ও সত্যের অপলাপ করার জন্য সচেতন আমেরিকানের অধিকাংশই আর ট্রাম্পের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না বলে প্রধান প্রধান জরিপে সোমবার রাতে বলা হয়েছে। মুসলিম কমিউনিটি এবং হিসপ্যানিকদের যে অংশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্পের পক্ষে মাঠে ছিলেন, তাদের মধ্যেও চির ধরেছে। দুই দিন আগে ট্রাম্পের এক উপদেষ্টা বলেছেন, পুনরায় নির্বাচিত হলে চার বছরের জন্য অভিবাসনের সব দরজা সংকুচিত করবেন ট্রাম্প। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকেও ভিসা প্রদানে কঠোর কড়াকড়ির আওতায় আনা হবে। এদিকে, সোমবার ট্রাম্পের এক টুইটে আভাস দেওয়া হয়েছে ভোট গণনায় সময়ক্ষেপণ করা হলে অনিবার্য সংঘাতের। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পেনসিলভেনিয়া, টেক্সাস, নেভাদায় ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় নির্বাচন কমিশনের আবেদন অনুযায়ী সময় বরাদ্দ করার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সমর্থকরা আদালতে গিয়েছিলেন। মাননীয় আদালত তা নাকচ করে দেওয়ার পরই ট্রাম্প ওই টুইট করেছেন। এ অবস্থায় ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত বড় বড় সিটিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যাসেচুসেটস, ওরেগনসহ বিভিন্ন স্থানে বড় বড় স্টোরের সামনে কাঠের ব্যারিকেড দেওয়া হচ্ছে। মূল্যবান সামগ্রী স্টোর থেকে নিরাপদ স্থানে সরানো হচ্ছে। স্টেট ও সিটি প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়েছে। হোয়াইট হাউস এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যদিও কোনো পক্ষ থেকেই সুনির্দিষ্ট কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি বড় ধরনের কোনো হাঙ্গামার। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদকালে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং সহায়-সম্পদ লুটের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না স্টেটগুলোর গভর্নররা। বাইডেন সোমবার সর্বশেষ নির্বাচনী সমাবেশ করেন ওহাইয়ো স্টেটের ক্লিভল্যান্ড এয়ারপোর্টে। সেখানে তিনি বলেন, ‘ওহাইয়োবাসী, আর একটি দিন অপেক্ষা করুন। এই যুক্তরাষ্ট্রকে যিনি বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন সেই প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়ার দিন হচ্ছে কাল মঙ্গলবার। এদিনে সেই প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করতে হবে, যিনি এই জাতিকে রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। মঙ্গলবার আমরা সেই প্রেসিডেন্টকে হটাতে পারব, যিনি দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে ঘৃণাকে উসকে দিয়েছেন।’ বাইডেন বলেন, ‘আমার কথা খুবই সাদামাটা। এই দেশের ক্ষমতার বলয়ে পরিবর্তন ঘটানোর পুরো ক্ষমতা আপনাদের হাতে। তার প্রয়োগ ঘটান ব্যালট বিপ্লবে।’

করোনা নিয়ে তামাশায় মনঃক্ষুণœ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রমণ রোগের বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসিকে বরখাস্তের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনের পরদিনই তিনি এ পদক্ষেপ নেবেন বলেও উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। এমন হুংকারের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বিকালে জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমাকে নির্বাচিত করুন, আমি অবশ্যই ফাউসিকে পুনরায় নিয়োগ দেব।’ বাইডেন উল্লেখ করেন, ‘আমরাই বরখাস্ত করতে যাচ্ছি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।’

অপরদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী সমাবেশে সোমবার আক্রমণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টকে। ট্রাম্প বলেছেন, আমাদের দেশ বড় বিপদে পড়েছে। পেনসিলভেনিয়ায় ডাকযোগে আসা ব্যালট নির্বাচনের পরদিনও বৈধ বলে গ্রহণের নির্দেশ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ট্রাম্প বিচারকদের কটাক্ষ করেন। উইসকনসিনের কেনোশা সিটিতে নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, বিচারপতিরা রাজনৈতিক নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। তারা তার প্রতিপক্ষকে বিজয়ের পথ সুগম করে দিচ্ছেন জাল ভোটকে গণনায় নিয়ে। এর ফলে ক্ষুব্ধ জনতা সংঘাতে লিপ্ত হতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জনগণকে সংঘাতে উসকে দেওয়ার ট্রাম্পের একটি টুইটকে চিহ্নিত করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ জরিপগুলোতে বাইডেন এগিয়ে : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট শুরুর প্রাক্কালে প্রকাশিত বিভিন্ন জরিপে বাইডেন এগিয়ে ছিলেন। রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিকস জরিপে বলা হয়েছে, নির্বাচনে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে। ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে রিপাবলিকান ট্রাম্পের চেয়ে ডেমোক্র্যাট বাইডেন মাত্র ২ দশমিক ৯ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। রিয়েল ক্লিয়ার পলিটিকস জরিপ বলছে, জাতীয় পর্যায়েও বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যকার ব্যবধান বেশি। এই ব্যবধান ৬ দশমিক ৫ পয়েন্ট। তবে এটা আগের চেয়ে কম। কিছু দিন আগেও বাইডেন প্রায় ৮ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন। ফাইভথার্টিএইটের ২ নভেম্বরের জরিপ অনুযায়ী ১৫টি ব্যাটলগ্রাউন্ড চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি অঙ্গরাজ্যেই ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বাইডেন। আর জাতীয়ভাবে ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন ৮ দশমিক ২ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে। ফাইভথার্টিএইটের জরিপ অনুযায়ী, বাইডেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন নিউ হ্যাম্পশায়ারে। সেখানে তিনি ১০ দশমিক ৯ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে। তিনি মিনেসোটায় এগিয়ে ৯ দশমিক ৩ পয়েন্ট ব্যবধানে। উইসকনসিনে ৮ দশমিক ২ পয়েন্ট ও মিশিগানে ৮ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে বাইডেন। ট্রাম্প এগিয়ে আইওয়া, টেক্সাস ও ওহাইওতে। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৯ কোটি ৭০ লাখ ভোটার ডাকযোগে বা সশরীরে আগাম ভোট দিয়েছেন। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, আগাম ভোটের ৫৪ শতাংশ ডেমোক্র্যাটিক এবং ৪৫ শতাংশ রিপাবলিকানদের ঝুলিতে পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর