বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
ই-কমার্সের নামে ডিজিটাল প্রতারণা

হাতিয়ে নিয়েছে ২২ লাখ গ্রাহকের ২৬৮ কোটি টাকা

আলী আজম

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক যুবক গড়ে তোলেন প্রতারণার সিন্ডিকেট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ই-কমার্স ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অনলাইনে অ্যাপসের মাধ্যমে শুরু করেন অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা। মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানে সেই সিন্ডিকেটটি এ ব্যবসা ছড়িয়ে দেয় বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশে।

রাতারাতি ৫ লাখ প্রবাসী ও বিদেশি গ্রাহকসহ ২২ লাখ গ্রাহক যুক্ত করে তারা, যাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা। এ টাকা বৈধ করার জন্য নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বিভিন্ন জায়গায় কেনা হয়েছে জমি। ইতিমধ্যে এ চক্রের মূল হোতা আলামিন প্রধানসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- আলামিন প্রধান (এমডি ও সিইও); মো. জসিম (নির্বাহী অফিসার); মো. মানিক মিয়া (ম্যানেজার, হিসাব); মো. তানভীর আহমেদ (ম্যানেজার, প্রোডাক্টস); মো. পাভেল সরকার (সহকারী ম্যানেজার, প্রোডাক্টস) এবং অফিস সহকারী নাদিম মো. ইয়াসির উল্লাহ। তাদের বিরুদ্ধে কলাবাগান থানায় মামলা হয়েছে।

ডিবিসূত্রে জানা গেছে, এ চক্রের মূল হোতা আলামিন প্রধান। ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস’ নামে কোম্পানি খুলে এ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। মাত্র এইচএসসি পাস আলামিন একসময় ডেসটিনিতে চাকরি করতেন। সেখান থেকেই প্রতারণার খুঁটিনাটি শেখেন। ডেসটিনি বন্ধ হওয়ার পর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি  করতে থাকেন তিনি। এ সময় তার এক বন্ধু তার কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা ধার নেন। এর কয়েক মাস পর ওই বন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত হ্যারিয়ার গাড়ি নিয়ে দেখা করতে যান আলামিন প্রধান। এতে হতবাক হয়ে যান ওই বন্ধু। এর কয়েক মাস আগে রাতারাতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। ডেসটিনির প্রতারণার মাধ্যম অনুসরণ করে ডিজিটাল রূপে ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস’ কোম্পানি খোলার পরিকল্পনা করেন। এরপর স্ত্রী শারমিন আক্তার, বন্ধু ইয়াছিন ও নিজের নামে ই-কমার্স ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের মাধ্যমে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি শুরু করেন এমএলএম ব্যবসা। প্রশাসন যাতে বুঝতে না পারে এটি এমএলএম ব্যবসা এ জন্য রেজিস্টার্ড গ্রাহকদের কাছে এসপিসি ব্র্যান্ডের নামে বিএসটিআই অনুমোদনের সিলযুক্ত বিভিন্ন পণ্য বিক্রি ও অনলাইনে বিজ্ঞাপন সাবমিট করার অপশন রাখা হয় অ্যাপসে। দেশীয় ‘আর্টিফিশিয়াল সফট’ নামে একটি আইটি কোম্পানি থেকে তৈরি করা হয় অ্যাপসটি। ভারতীয় আমাজন সার্ভারের মাধ্যমে করা হতো বুস্টিং, যাতে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা গ্রাহকরা নিয়মিত আপডেট পেতে পারেন। এ জন্য আমাজনকে মাসে ৭ হাজার ডলার দিতে হতো তাদের। আর গ্রাহকদের কাছ থেকে বিকাশ-নগদ-রকেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া টাকা জমা হতো আলামিন প্রধানের আটটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, যেখানে মাত্র ১২ কোটি টাকা জমা রেখে বাকি টাকা পাচার, জমি ও গাড়ি কিনে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের এমডি ও সিইও, প্রতারণার মূল হোতা আলামিন প্রধান ও নির্বাহী অফিসার মো. জসিমকে গ্রেফতারের পর ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি, দুটি পিকআপ ভ্যান, সার্ভারে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, রাউটার, দুটি পাসপোর্ট ও কোম্পানির বিভিন্ন কাগজপত্র জব্দ করা হয়। এর আগে ২৬ অক্টোবর রাজধানীর কলাবাগানের এফ হক টাওয়ারের ষষ্ঠ তলায় কোম্পানির অফিসে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় ম্যানেজার মানিক, প্রোডাকশন ম্যানেজার তানভীর, সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার পাভেল ও অফিস সহকারী নাদিমকে। কোম্পানির অফিসে অভিযানের পরদিন ২৭ অক্টোবর কলাবাগান থানায় একটি মামলা হয়। গতকাল ওই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আলামিন প্রধান ও নির্বাহী অফিসার মো. জসিমকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত আলামিন প্রধানের চার দিন ও জসিমের তিন দিন রিমান্ড মঞ্জুর করে। গতকাল সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ই-কমার্সের লাইসেন্স নিয়ে যাত্রা করে চক্রটি। আলামিন প্রধান একসময় ডেসটিনিতে সক্রিয় ছিলেন। এ ১০ মাসে তারা সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে উচ্চ কমিশনের প্রলোভন দেখিয়ে ২২ লাখ ২৪ হাজার ৬৬৮ জন সদস্যের কাছ থেকে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তাদের ব্যবসা কার্যক্রম অনলাইন অ্যাপভিত্তিক হওয়ায় বাংলাদেশের বাইরেও ১৭টি দেশে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীর পাশাপাশি প্রায় ৫ লাখ বিদেশি সদস্য রয়েছেন। চক্রটি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস ঠিকানার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে শত শত পোস্টের মাধ্যমে ই-কমার্সের কথা বলে উচ্চমাত্রার কমিশনের লোভ দেখিয়ে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। আগ্রহীরা গুগল প্লে-স্টোর থেকে একটি মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করে রেজিস্ট্রেশন করেন। রেজিস্ট্রেশনের সময় বাধ্যতামূলকভাবে আপলিঙ্ক আইডির রেফারেন্সে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট (বিকাশ, নগদ, রকেট) নম্বরে প্রতি আইডির জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা করে দিতে হতো। গ্রাহকদের দেখানো হতো রেফার কমিশন, জেনারেশন কমিশন, রয়্যাল কমিশনের প্রলোভন। এ ক্ষেত্রেও অবলম্বন করা হতো ডেসটিনির পদ্ধতি। রেফার করা ব্যক্তি তার নিচের তিনটি আইডি থেকে ৪০০ টাকা করে কমিশন লাভ করবেন। এরপর ওই তিনটি আইডি থেকে যখন ৩ দ্ধ ৩ = ৯ আইডি হবে তখন আপলিঙ্কের আইডি ২০ শতাংশ কমিশন পাবে। এরপর ডাউনলিঙ্কের যত আইডি হবে তার আইডি ১০ শতাংশ হারে কমিশন পাবে, যা মূলত পিরামিড আকৃতির হয়। এ ধরনের ব্যবসা দেশের আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চক্রটি এমএলএম ব্যবসা আড়াল করার জন্য নামমাত্র কয়েকটি পণ্য- যেমন অ্যালোভেরা শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, চাল, ডাল, মরিচের গুঁড়া তাদের রেজিস্টার্ড সদস্যদের কাছে বিক্রি করত। এর লভ্যাংশ থেকে প্রতি আইডি হোল্ডারকে কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখার বিনিময়ে ১০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সিনিয়র এসি মো. নাজমুল হক বলেন, ‘ব্যবসার নামে অ্যাপ ও ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতারণা ঠেকাতে ডিবি, সিআইডি ও সিটির সাইবার ইউনিট সব সময় নজরদারি রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামে প্রতারণামূলক কোম্পানির মূল হোতাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি আমাদের নজরদারিতে আছে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

নিঃস্ব শত শত গ্রাহক : এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস কোম্পানিতে শুরুর দিকে বিনিয়োগ করে লাভের মুখ দেখেন অনেকে। তাদের আয়ে প্রলুব্ধ হয়ে শত শত মানুষ শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বিনিয়োগ করতে থাকেন, যা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তারা। তেমনই একজন মিরপুরের বাসিন্দা আবু নাসিম। বন্ধুদের মাধ্যমে প্রলুব্ধ হয়ে পৈতৃক ভিটা বন্ধক রেখে ১ হাজার ২০০ টাকা করে প্রায় ৮৩ হাজার টাকায় মোট ৬৯টি আইডি কেনেন। লাভ দূরের কথা, সব টাকা হারিয়ে এখন নিঃস্ব আবু নাসিম। শুধু নাসিম নন, সর্বস্ব বিক্রি করে এ ব্যবসায় আসা হাজারো ব্যক্তির রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। প্রতারকদের উপযুক্ত সাজার পাশাপাশি নিজেদের টাকা ফেরত চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর