শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পরাজয় ঠেকাতে ট্রাম্পের মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পরাজয় ঠেকাতে ট্রাম্পের মামলা

আপাত দৃষ্টে বলাই যায় দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ফলে সমাপ্তি ঘটার পথে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প অধ্যায়ের। গত চার বছর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিশ্বকে তুলাধোনো করা ট্রাম্প অবশ্য এখনো ভেলকি দেখাচ্ছেন। নিজের পরাজয় ঠেকাতে ট্রাম্প গিয়েছেন আদালতে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার এই যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের ফলাফল আসার পর ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়ে থাকা রাজনীতিকদের মতো আচরণ শুরু করেছেন। গণনায় ডেমোক্র্যাটদের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার আভাস পেয়েই কূটকৌশলের এক পর্যায়ে পরাজয় ঠেকাতে মামলা করেছেন ট্রাম্প। মিশিগান, পেনসিলভেনিয়া এবং জর্জিয়া স্টেটে ভোট গণনা বন্ধের দাবিতে মামলা করেছেন তিনি। হাস্যকর অভিযোগ করা হয়েছে যে, মিশিগানে ভোট গণনার সময় নাকি রিপাবলিকান পোলিং এজেন্টদের থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। ট্রাম্পের এজেন্টদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না নির্বাচনী কর্মকর্তারা।

জানা যায়, ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের প্রচারণা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মূলধারার গণমাধ্যমকে তুলাধোনো করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কথায় কথায় বিভিন্ন দেশের ওপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিতে বেশ পটু ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশেষ করে ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো ইস্যুতে বনিবনা না হলেই নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসে। এ ছাড়া নানা সমাবেশ বা কোনো সম্মেলনে নিজেকে সবার ওপরে রাখতে পছন্দ করেন তিনি। তার অঙ্গভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন সময় ভাইরাল হয়েছেন নেট দুনিয়ায়। এ ক্ষেত্রে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দাম্ভিক প্রেসিডেন্টও আখ্যা দেন অনেকে। পেনসিলভেনিয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, নির্বাচনের তিন দিন পর পর্যন্ত পাওয়া সব ব্যালট গণনা করতে হবে। সেভাবেই চলছে সবকিছু। এতদসত্ত্বেও ৪ নভেম্বর বুধবার মামলা করেছেন ট্রাম্পের সমর্থকরা। দাবি জানিয়েছেন, ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনার আওতায় আনা যাবে না। উল্লেখ্য, এমন বিধির দাবিতে নির্বাচনের আগে আদালতে গিয়ে হেরেছেন রিপাবলিকানরাই। জর্জিয়া স্টেটে নাকি মৃত মানুষের নামে ব্যালট পাঠানো হয়েছে ডাকযোগে। এরা বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন। এ ছাড়া মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টার পর আসা ৫৩টি ব্যালটকে কোনোভাবেই গণনায় নেওয়া যাবে না। কিন্তু নির্বাচনী কর্মকর্তারা তা গ্রহণ করেছেন। তাই সেখানকার গণনাও স্থগিতের আবেদনে মামলা করা হয়েছে। সব কটি মামলা দায়ের হয় বুধবার। উইসকনসিন স্টেটের গণনায় ট্রাম্প হেরে গেছেন। তাই সেখানে পুনরায় ভোট গণনার আবেদন জানানো হয়েছে। ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোট গ্রহণের সময়সীমা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বুধবার ভোররাতে হোয়াইট হাউসের লনে এক সমাবেশে নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেন এবং ডেমোক্র্যাটরা ফলাফল চুরি করছে বলে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প এহেন কারচুপির বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার হুমকি দেওয়ার সময়ই নিজেকে  জয়ী বলে উল্লেখ করেন। যদিও তখনো ভোট গণনা চলছিল এবং অনেক স্টেটের ফলাফল পাওয়া যায়নি। এভাবেই বুধবার সকাল পর্যন্ত সর্বমহলে টানটান উত্তেজনা দেখা দেয়। রিপাবলিকান পার্টির নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাকে উদ্ভট অভিযোগ থেকে বিরত হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল ততই ভোট গণনায় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে থাকে। যদিও অবশিষ্ট স্টেটসমূহে বাইডেন আর ট্রাম্পের মধ্যকার ব্যবধান খুব বেশি ছিল না। তবুও মাঠের সংবাদ দ্রুত সংগ্রহ করার পরই মিশিগান, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়ায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন। ভোটারের দেওয়া রায়ের প্রতি শতভাগ সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন জো বাইডেনসহ ডেমোক্র্যাটরা। তারা ট্রাম্পের প্রতিও অনুরোধ জানিয়েছেন ধৈর্য ধরার জন্যে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে না দিতেও আহ্বান জানানো হচ্ছে ট্রাম্পের প্রতি।

সারা বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুও হয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের। ট্রাম্প শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের হুমকিকে খাটো করে দেখিয়েছেন। ভাইরাসটিকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এমনকি মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারেও তিনি বারবার বাধা দিয়েছেন। বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের সমালোচনাতেও তিনি কখনো কখনো মুখর হয়েছেন। তাই করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ। জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের সতর্কতা সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু মার্চ মাসের পর থেকে ধীরে ধীরে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

একবার বিপক্ষে সংবাদ প্রচারের জন্য মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএনকে ‘মিথ্যুক’ আখ্যা দিয়ে আক্রমণ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আক্রমণ করতে ছাড়েননি নিউইয়র্ক টাইমসকেও। ট্রাম্প বলেছিলেন, নিউইয়র্ক টাইমসেরও সিএনএনের মতো অবস্থা। গণমাধ্যমগুলোর সামনে অহংকার করে বলেছিলেন, এরা বেশি দিন ব্যবসা করতে পারবে না। মজার ব্যাপার হলো ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের পর নিউইয়র্ক টাইমসের গ্রাহকের সংখ্যা ছিল আকাশচুম্বী।

হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রশাসন এবং মূলধারার গণমাধ্যমের মাঝে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বারবার। নানা সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের হেনস্তার শিকার হতে হয় সাংবাদিকদের। শুধু সংবাদ সম্মেলনে নয়, নির্বাচনী সমাবেশেও মূলধারার বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমের সঙ্গে দাম্ভিকতা নিয়ে বেশ সমালোচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। একসময় হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভেবেছিলেন তিনি। যা রীতিমতো সমালোচনার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে নিন্দাও জানায়।

ট্রাম্পের আমলে দেশটিতে বর্ণবাদী আচরণ তীব্রভাবে লক্ষ্য করা গেছে। একবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা এ রকম বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলোর মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বরং উচিত নরওয়ে বা উন্নত দেশগুলো থেকে অভিবাসীদের আনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এমন দুঃখজনক বক্তব্য আশা করা যায় না বলে নিন্দা জানায় জাতিসংঘ।

সম্প্রতি দেশটির পুলিশের হাতে নির্মমভাবে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড নামের এক মার্কিনি নিহত হন। দেশজুড়ে এর প্রতিবাদে গণআন্দোলন শুরু হলে তখনো প্রশাসনের পক্ষ নেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের সময় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। বরাবরই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ট্রাম্প। আশ্রয়রত বা অভিবাসীদের বিপজ্জনক ও হিংস্র অপরাধী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াকে তিনি আমেরিকাকে শক্তিশালী করার প্রতিজ্ঞা করেন। আর এই পথেই মহান আমেরিকা গঠন সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। ট্রাম্পের এমন কর্মকান্ডকে অহংকার আর ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের প্রতিফলন মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ৪৫ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১০ জন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে পারেননি। এদের মধ্যে সবশেষ জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে তিনি ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে যান।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর