শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মেয়াদ ফুরিয়ে যায় কমিটি হয় না

বেহাল বিএনপির ১১ সহযোগী সংগঠন

মাহমুদ আজহার

মেয়াদ ফুরিয়ে যায় কমিটি হয় না

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই করুণ। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর স্বেচ্ছাসেবক দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ও ইয়াসিন আলীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর পর আবারও আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়ে দুই দফা কমিটি হলেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি স্বেচ্ছাসেবক দল। অবশ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ৩৩১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিএনপির

হাইকমান্ডকে জমা দেন। পরে ১৪৯ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ঘোষিত কমিটিতে বাদ পড়ে যান সংগঠনটির অনেক ত্যাগী নেতা। সর্বশেষ ঘোষিত কমিটিতে শফিউল বারী বাবু সমর্থকদের অনেকেই বাদ পড়ে যান বলেও অভিযোগ তাদের।

শুধু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলই নয়, বিএনপির ১১টি অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের প্রায় সবকটির অবস্থা একই। মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, কমিটি হয় না। আবার আংশিক কমিটি হলেও তা নিয়েই মেয়াদ শেষ হয় সংগঠনগুলোর। আবার কমিটি হলেও শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও হতাশায় নিমজ্জিত। এর কারণ হিসেবে সাধারণ নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, মূলত ‘মাই ম্যান’ রাখাকে ঘিরেই শীর্ষ নেতৃত্বে দ্বন্দ্ব হয়। এ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে কমিটিসহ নানা কারণে কমিটি গঠনে বিলম্ব হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দোহাই দিয়ে সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা নিজের লোকজনকে কমিটিতে রাখতে মরিয়া হন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এখন দেশে করোনাকাল চলছে। এ অবস্থায় সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম চালানো কঠিন। তবুও আমি মনে করি, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি দেওয়া হবে। ত্যাগী, পরীক্ষিত ও নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের দিয়েই কমিটি হবে।

২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে যুবদলের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিকে ১ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশনা দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর মধ্যে গত ৬ ফ্রেব্রুয়ারি যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১০৯ জনকে পদ-পদবি দেওয়া হয়। এখনো সংগঠনটি পায়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা করোনাকালসহ নানা অজুহাতে কমিটি গঠনে বিলম্বের কথা জানান। কিন্তু সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, চার বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না করার বিষয়টি কোনো অজুহাতই হতে পারে না। যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেই তারা কমিটি গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। খুব শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে বলে জানান তারা।

কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করার দীর্ঘদিন পর ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হলো। গত বছরের ১৮ অক্টোবর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বর ৬০ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের আংশিক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বিগত ১১ মাসেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি বিএনপির এই সংগঠনটি।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আনোয়ার হোসাইনকে সভাপতি ও নূরুল ইসলাম নাসিমকে সাধারণ সম্পাদক করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে এ সংগঠনটি। পরে গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১ সদস্যের পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা। এর পর ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে শ্রমিক দলের বিদ্রোহী নেতা ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ বিএনপি স্বীকৃত কমিটি ‘গঠনতন্ত্র মোতাবেক গঠিত হয়নি’ মর্মে অভিযোগ করে একটি বিএলএল মামলা করেন। শ্রমিক দলের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

২০১৩ সালের ২৪ নভেম্বর ইশতিয়াক আজিজ উলফাত সভাপতি এবং শফিউজ্জামান খোকনকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯১ সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিএনপির গঠনতন্ত্রে এক ব্যক্তির এক পদ বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি নেন শফিউজ্জামান খোকন। পরে বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশে সংগঠনের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানকে মুক্তিযোদ্ধা দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে এখন মুক্তিযোদ্ধা দল।

২১ বছর পর ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় শামসুজ্জামান দুদুকে এবং সদস্য সচিব করা হয় কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনকে। ওই সময় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন আহ্বায়ক কমিটি তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিল করে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করবে। কিন্তু মাস পেরিয়ে বছর গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় না। এখন পর্যন্ত সংগঠনটি আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেলেও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সংগঠনটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে গ্রুপিং ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের অনুসারীদের মধ্যে কয়েকবার হাতাহাতি, মারামারি ও চুল টানাটানি হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৫ মাসে তারা ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৩০টির কাউন্সিল সম্পন্ন করে। যার মধ্যে ২৬টি জেলা কমিটি  ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর আর কাউন্সিল করতে পারেনি। ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল সংগঠনটির ২৬৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। গত ৮ মার্চ নয়াপল্টনে এক অনুষ্ঠানে হট্টগোলের পর চরম ক্ষুব্ধ হয় বিএনপির হাইকমান্ড। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সর্বশেষ ঢাকা-১৮ আসনের উপ নির্বাচনে শীর্ষ তিন নেত্রী তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস)। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদকে সভাপতি করে বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) আংশিক কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। ৩০ সদস্যের আংশিক কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করা হয় চিত্রনায়ক হেলাল খানকে। এরপর ১৮৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করলেও বর্তমানে সংগঠনটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে জাসাসের কর্মকা-ও এখন স্থবির প্রায়।

আবুল কালাম আজাদকে আহ্বায়ক ও মো. মজিবুর রহমানকে সদস্য সচিব করে ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের ১০৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সংগঠনটিকে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিল করে কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। গুটি কয়েক নেতার হাতেই বন্দী তাঁতী দল। মাঠ পর্যায়ে সংগঠনটির কার্যক্রম তেমনটি নেই। একই দিনে জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের ১৭১ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় মাওলানা শাহ মো. নেসারুল হক, যিনি বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সদস্য সচিব করা হয় মাওলানা মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারকে। ১৩৬ জনকে সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন ও কাউন্সিল করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে ব্যর্থ হয়। শুধু দিবসভিত্তিক মিলাদ মাহফিল কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ ওলামা দল।

সর্বশেষ খবর