সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আনন্দের জোয়ারে যুক্তরাষ্ট্র

মুসলিম ব্যান আর অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের বিধি বাতিল করবেন বাইডেন, বিভক্ত জাতির ঐক্য ফিরিয়ে আনার ডাক

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

আনন্দের জোয়ারে যুক্তরাষ্ট্র

ক্যালিফোর্নিয়ায় বাইডেন সমর্থকদের উল্লাস -এএফপি

চার বছর ট্রাম্পের অপশাসনে অতিষ্ঠ আমেরিকানরা বাইডেনের বিজয় বার্তা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় রাস্তায় নেমে উল্লাস করলেন। যারা গাড়ি চালাচ্ছিলেন তারা লাগাতার হর্ন বাজিয়ে নিজেদের আনন্দের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বহুতল ভবনের জানালায় পতাকা নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছেন বাইডেন-কমলা জুটিকে। নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া থেকে ডেলওয়ারে, ম্যারিল্যান্ড-ভার্জিনিয়া-মিশিগান-ফ্লোরিডা-জর্জিয়া-টেক্সাস-ক্যালিফোর্নিয়া সর্বত্র হয় স্বতঃস্ফূর্ত বিজয়-সমাবেশ।

আগে থেকে ঘোষিত ছিল না এমন বিজয়-র‌্যালির বা আনন্দ সমাবেশের। কিন্তু বিশ্বখ্যাত টাইমস স্কোয়ার, কলম্বাস সার্কেল, ইউনিয়ন স্কোয়ার, ন্যাশনাল মল, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সিটি, সংবিধান রচনার ঐতিহাসিক ভূমি সর্বত্র মুখরিত হয় বাইডেন-কমলা স্লোগানে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পতনের সংবাদে সবাই স্বস্তি পেয়েছেন এব তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। সর্বত্র একটি দৃশ্য সবাইকে অভিভূত করেছে যে, অংশগ্রহণকারীরা কেউই মাস্ক ছাড়া ছিলেন না। আনন্দে উদ্বেলিতরা সামাজিক দূরত্বের কথা ভুলে গেলেও স্বাস্থ্যবিধির পরিপূরক অন্যসব নির্দেশনা মেনেই দিনভর সমাবেশ, উল্লাস, মিষ্টিমুখ করেন।

জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার খবরে হোয়াইট হাউসের বাইরে জমায়েত হয়েছেন উচ্ছ্বসিত বাইডেন সমর্থকরা। সেখানে জড়ো হয়ে বিজয় উদযাপনে মেতেছেন হাজারো বাইডেন সমর্থক। ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের পদভারে মুখরিত পুরো এলাকা। হোয়াইট হাউসের বাইরের রাস্তায় এখন উৎসবের আমেজ। গাড়ির হর্ন ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিজেদের উচ্ছ্বাসের জানান দেন বাইডেন সমর্থকরা। গান-বাজনা আর শ্যাম্পেইনের বোতল নিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায় তাদের। সমবেত জনতার অনেকের হাতেই ছিল মার্কিন পতাকা। সমকামীদের পতাকা নিয়েও সেখানে হাজির হন অনেকে। কেউবা আবার এসেছিল ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার লেখা টি-শার্ট পরে। উচ্ছ্বসিত ডেমোক্র্যাটদের ভিড় এতটাই বেশি ছিল যে, মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে এক পর্যায়ে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর বিজয়-ভাষণে বিভেদ ভুলে ঐক্যের ডাক দিলেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সময় ট্রাম্প-সমর্থকদের প্রতি তার সহযোগিতার কথাও বলেন, যারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, আপনাদের হতাশাটা আমি বুঝি। আমিও বেশ কয়বার পরাজিত হয়েছি। কিন্তু এখন একে অন্যকে সুযোগ দিতে হবে।

সিটি কাউন্সিল থেকে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ইউএস অ্যাটর্নির পথ ধরে কংগ্রেসম্যান-ইউএস সিনেটরের দায়িত্ব পালনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ইতিহাসের জনক বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী জো বাইডেন ১৭ মিনিটের এ ভাষণে বলেন, আমাদের দুই পক্ষের আবারও একে অন্যের কথা শোনার সময় এখন। উদারচিত্তে বাইডেন বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রকে সারিয়ে তোলার সময়। বাইডেন বলেছেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কাজটি আমরা শিগগিরই শুরু করব। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে পরিবেশবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নির্বাচনের সময় নানা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য, আচরণ ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট বললেন, কে কাকে ভোট দিয়েছেন, কে কার সমর্থক, সব ভুলে যেতে হবে।

ট্রাম্পের গত চার বছরের অপশাসনে ক্ষতবিক্ষত জাতি গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের পরম মূল্যবোধগুলোর পুনর্গঠন যে তার প্রথম কাজ, সে কথাও অবলীলায় উপস্থাপন করলেন ৪৭ বছরের অধিক সময় ধরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ৭৭ বছর বয়সী বাইডেন। বলেন, এখন সময় কর্কশ কথাবার্তা দূরে ঠেলে রাখার। উত্তেজনা কমিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে হবে। উন্নতি করতে হলে আমাদের বিপক্ষ দলকে শত্রু ভাবা বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, তারা আমাদের শত্রু নয়, তারা আমেরিকান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ জবাব দিয়েছে। তারা আমাদের পরিষ্কার বিজয় এনে দিয়েছে। আমি বিভেদ নয়, ঐক্য চাই। কোন রাজ্য নীল, কোন রাজ্য লাল, তা আমি দেখি না। আমি দেখি যুক্তরাষ্ট্রকে। বিশ্বে গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বের সম্মান ফেরানোরও প্রতিশ্রুতি দেন বাইডেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের মূল শক্তির পুনর্গঠন করতে চাই। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে টেনে তুলতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই, যাকে সারা বিশ্ব সম্মান করবে।

ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের নিজ শহর উইলমিংটনে জাতির উদ্দেশে এই বিজয়ী ভাষণের মঞ্চে প্রথমেই বক্তব্য দেন নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। প্রত্যয়ের সঙ্গে কমলা হ্যারিস বলেন, নতুন নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে তার দেশের জনগণ নতুন দিনের সূচনা করেছেন। গণতন্ত্র যখন ঝুঁকিতে, ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ আমেরিকার জন্য নতুন দিনের সূচনা করেছেন। কমলা বলেন, আমাদের দেশকে যারা সুন্দরভাবে গড়ে তুলেছেন, সেই আমেরিকান জনগণকে ধন্যবাদ।

প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন কমলা। তিনি প্রথম অশ্বেতাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান বংশো™ভূত আমেরিকান। কমলা বলেন, আমি জানি, সময়টা চ্যালেঞ্জিং; বিশেষ করে গত কয়েক মাস। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, উদ্বেগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা আপনাদের  ধৈর্য, সাহস, সহনশীলতা ও সহানুভূতি দেখেছি। কমলা উল্লেখ করেন, চার বছর ধরে মার্কিন জনগণ সমতা, ন্যায়বিচারসহ ধরিত্রী রক্ষার জন্য রাজপথে লড়াই করেছেন। তারপর ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনারা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। আপনারা আশা, ঐক্য, শালীনতা, বিজ্ঞান ও সত্যকে বেছে নিয়েছেন। আপনারা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনকে বেছে নিয়েছেন। জো বাইডেনকে একজন লড়াকু ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করে কমলা বলেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি প্রথম নারী হতে পারি, তবে শেষ নারী নই।

মুুসলিম ব্যান আর অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের বিধি বাতিল করবেন বাইডেন : আমেরিকানদের প্রত্যাশার পরিপূরক হিসেবে ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পরই ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের গণবিরোধী সব নির্বাহী আদেশ বাতিল/বিলুপ্তির নির্দেশ জারি করবেন। এর মধ্য দিয়েই আমেরিকা আবারও বিশ্ব সম্প্রদায়ের নৈকট্য লাভের পথে অগ্রসর হবে। বাইডেন টিমের পদস্থ এক কর্মকর্তা/সংগঠক গতকাল এ আভাস দিয়েছেন। বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ির নির্দেশ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রকে একঘরে করে ফেলার মতো অকল্পনীয় একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে। শিশুকালে মা-বাবার সঙ্গে বেআইনি পথে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর যারা অভিবাসনের স্ট্যাটাস পাননি, অথচ তারা যুক্তরাষ্ট্রের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন, উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন, যারা জন্মগ্রহণকারী দেশটি আর কখনো দেখেননি বা সেই দেশের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত নন, এমন আট লক্ষাধিক তরুণ-তরুণীর বৈধতার যে রোডম্যাপ ওবামা প্রশাসন জারি করেছিল, তা নিষিদ্ধে ট্রাম্পের আদেশটিও বাতিল করা হবে। উল্লেখ্য, মাঠ পর্যায়ে খোঁজখবর নেওয়ার মাধ্যমে বাইডেন টিম জনপ্রত্যাশার পরিপূরক আরও কিছু পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যে জো বাইডেনকে অবহিত করেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেও গ্রিনকার্ড পাননি এমন সোয়া কোটি কাগজপত্রহীন বিদেশির মধ্যে যারা নিয়মিত ট্যাক্স দিয়েছেন, শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ ঘটিয়েছেন জন্মগত আমেরিকানদের মতো, তাদের শর্ত সাপেক্ষে বৈধতা প্রদানের বহুল প্রতাশিত দাবির ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা আসতে পারে। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে শুরু থেকেই আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও শোনা যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ/নিয়ন্ত্রণে একটি টাস্কফোর্স গঠনের ব্যাপারেও শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী আর বিদগ্ধজনদের সঙ্গে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে থাকাবস্থায়ই বাইডেন আর কমলা কথা বলেছেন। আর এই টাস্কফোর্সের কো-চেয়ার হতে যাচ্ছেন সাবেক সার্জন জেনারেল তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিবেক এইচ মার্থি এবং অবসরপ্রাপ্ত এফডিএ কমিশনার ডেভিড কেসলার। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ/নির্মূল/প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয়- এমনভাবে সবকিছু সাজানোর কথা ভাবছেন বাইডেন। এ কথা ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনেও শনিবার উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনের মতে বাইডেন-কমলা প্রশাসনে বাংলাদেশি-আমেরিকানরাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে পারেন। কারণ এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সোচ্চার থাকার বিষয়টি উভয়কেই মুগ্ধ করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ‘সাউথ এশিয়ান্স ফর বাইডেন’-এর চিফ অ্যাডভাইজার ছিলেন ক্লিনটন আমলের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী ওসমান সিদ্দিক। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সারা আমেরিকায় ‘বাংলাদেশিজ ফর বাইডেন’ মোর্চা গঠিত হয়। আরও উল্লেখ্য, ওবামা আমলে বাংলাদেশি ড. নীনা আহমেদ ছিলেন এশিয়াবিষয়ক উপদেষ্টা। ড. নীনা এবার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়নে পেনসিলভেনিয়া স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল পদে লড়ে ৩০ লক্ষাধিক ভোট পেয়েও জয়ী হতে পারেননি। তার ব্যাপারেও বাইডেন-কমলার দুর্বলতা রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

 

সর্বশেষ খবর