সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্ধ পাটকল পরিচালনা করা হবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়

নিজামুল হক বিপুল

বন্ধ পাটকল পরিচালনা করা হবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়

গোলাম দস্তগীর গাজী

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বীরপ্রতীক বলেছেন, সরকার লোকসান থেকে মুক্তি পেতেই সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাত যাতে আরও বেশি উৎসাহিত হয় সে জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। জানিয়েছেন, বন্ধ পাটকলগুলো পিপিপি বা লিজের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা হবে। খুব শিগগিরই সরকার এই প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি পাওনাও চলতি মাসেই পরিশোধ করা হবে। তিনি বলেছেন, সরকার বহুমুখী পাটপণ্যের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। গতকাল সচিবালয়ে পাট মন্ত্রণালয়ের নিজ দফতরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী।

প্রশ্ন : করোনাকালে পাট খাত রপ্তানিতে ভালো করেছে। এর পেছনে আপনার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী?

গোলাম দস্তগীর গাজী : পাট খাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে একটা অসামঞ্জস্য বিরাজ করছিল। ফলে প্রাইভেট সেক্টরে যারা তারা অনেকবার বলেছিল, সরকারি খাতের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ সরকারি পাট খাত লোকসান দিচ্ছে। সরকার যে ভর্তুকি দেয় সেই ভর্তুকির টাকা মাইনাস করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে পণ্য বিক্রি করে। যা বেসরকারি খাতের উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম।  সরকারের গত টার্মে ভারত থেকে একটা টিম আসল আমাদের এখানে এন্ট্রি ডাম্পিং ডিউটির বিষয়টি তদন্ত করতে। ভারতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে আমরা তাদের চেয়ে কম দামে সেখানে রপ্তানি করি কিনা? তারা তদন্ত করে দেখল, বিজেএমসি লোকসানি মূল্যে ভারতে পাট বিক্রি করছিল। এরপরই তারা আমাদের ওপর এন্ট্রি ডাম্পিং ডিউটি বসিয়ে দিল। এরপর আমরা আর ভারতের বাজারে ঢুকতে পারলাম না। বাজারটা বন্ধ হয়ে গেল। এখানে প্রাইভেট সেক্টরের ৭০-৭৫ শতাংশ শেয়ার ছিল। ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার পাট যেত।

সরকারি ভর্তুকির কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হলো। লোকসান হলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে আমরা সবাই জানি যে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি একটা লোকসানি প্রতিষ্ঠান। তাদের কারণে আমাদের প্রাইভেট সেক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজেএমসি একটা শ্বেতহস্তী। সরকারের জন্য একটা বোঝা।

আমরা চিন্তা করলাম, সরকারি মিলগুলোকে পিপিপিতে নেওয়া যায় কিনা। কারণ এর আগে যেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল সেগুলোতে আর মিল করেননি মালিকরা। তাই আমরা যেসব মিল বন্ধ করেছি সেগুলোকে পিপিপি বা লিজের মাধ্যমে চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছি। তাহলেই পাটশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। বিক্রি করে দিলে এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না।

প্রশ্ন : পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার নেপথ্যে কারণ কী?

গোলাম দস্তগীর গাজী : আসলে আমাদের সরকারি মিলগুলোতে শ্রমের মূল্য প্রাইভেট মিলগুলোর মূল্যের চেয়ে ডাবল। কারণ সরকারি মিলগুলো পে-স্কেলের বাইরে যেতে পারে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে সেটি মানতে হয় না। যার ফলে আমাদের কস্ট অব প্রোডাকশনটা বেশি। এ ছাড়া আরও অনেক রকম লিকেজ থাকে। একটা মেশিন রিপিয়ারিং করতে গেলে টেন্ডার করতে হয়, নানান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। দীর্ঘ সময় লাগে। তখন মেশিন নষ্ট থাকলেও শ্রমিকের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া অসৎ উপায়ও আছে। যেটা প্রাইভেটের ক্ষেত্রে থাকে না। প্রাইভেট সেক্টরে এক দিনের মধ্যেই মেশিন রিপিয়ারিং হয়ে যায়। এ ছাড়া সরকারি মিলগুলোর মেশিন অনেক পুরনো। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ব্যবহার হয় আধুনিক মেশিন। সরকারি মিলগুলোর তিনটি মেশিনে যে উৎপাদন হয়, বেসরকারিতে একটি মেশিনে একজন শ্রমিক দিয়ে তার চেয়ে বেশি উৎপাদন করা যায়। তাছাড়া বেসরকারি মিলে মজুরিও কম। এসব কারণে সরকারি মিলগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মূলত এ কারণেই সরকার লোকসান থেকে মুক্তি পেতে মিলগুলো বন্ধ করেছে। 

প্রশ্ন : পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় সরকার কি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে?

গোলাম দস্তগীর গাজী : এখানে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুভাবেই সরকার লাভবান হয়েছে। সরকার যেখানে বছরে ১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিত, সেটা বন্ধ হলো। অন্যদিকে প্রাইভেট খাত যে অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছিল সেটা থেকে রক্ষা পেল এবং উৎপাদনে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : এত লোকসানের পরও সরকার কেন বছরের পর বছর ভর্তুকি দিচ্ছিল?

গোলাম দস্তগীর গাজী : সরকার মনে করছিল হয়তো কোনো না কোনো সময় তারা লাভবান হবে। এ জন্য সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছিল।

প্রশ্ন : বিজেএমসির অনিয়ম দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র... এসব কারণেই কি সরকার বছরের পর বছর ভর্তুকি দিচ্ছিল?

গোলাম দস্তগীর গাজী :  কে কী করেছে বা করেনি সেটা বলতে পারব না। আমি দায়িত্বে আসার পর মনে করেছি, এভাবে এই খাত চলতে পারে না। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, এভাবে এই খাতকে আর কতদিন চালাবেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে একটি রিপোর্ট দিতে বললেন। কীভাবে এটিকে লোকসানমুক্ত করা যায় সে বিষয়েও পরামর্শ দিতে বললেন। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে বিস্তারিত একটা রিপোর্ট পাঠালাম। তারপর প্রধানমন্ত্রী মিটিং করলেন। বললেন, এভাবে এই মিল চলতে পারে না। এটিকে বিক্রি না করে পিপিপির মাধ্যমে বা লিজের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তর করা যায় কিনা। শ্রমিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাদের পাওনা যেন পরিশোধ করা হয়, যারা চাকরি করতে পারবে তাদের যেন চাকরি দেওয়া হয়। আমরা সেভাবেই কাজ করেছি। 

প্রশ্ন : এই সরকারি মিলগুলো বন্ধ করে দিলেন এতে করে পাট চাষিদের মধ্যে হতাশা আসবে কিনা, তারা পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে কিনা? পাট চাষ বন্ধ হয়ে যাবে কিনা?

গোলাম দস্তগীর গাজী : দেখেন আমরা থ্রো এনালাইসিস করে দেখলাম, পাট খাতে সরকারি খাতের শেয়ার মাত্র ৫ শতাংশ আর বেসরকারি খাতের শেয়ার ৯৫ শতাংশ। এটা দেখার পর বললাম, সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা অযথা দিচ্ছে। এটার কোনো ভ্যালু নেই। তাহলে কেন এখানে সরকার ভর্তুকি দেবে। তারপরই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সরকারি মিলগুলো বন্ধ করে দিতে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলো। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম এতে অনেক উন্নতি হয়েছে।

বাজারে পাটের মূল্য বাড়তে থাকল। কৃষকরা যে পাটের মণ বিক্রি করেছিল ১৫০০ টাকা, সেটি গিয়ে দাঁড়াল ৩ হাজার টাকায়। এই বাড়তে থাকার পেছনে মূল কারণ সরকারি মিল বন্ধ করে দেওয়া। আমার বিশ্বাস, পাট চাষিরা আশান্বিত ও আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। আগামী বছর তারা আরও অধিক হারে পাট উৎপাদন করবেন বলে আমি আশা করছি। আমরা দেখলাম, করোনার মধ্যে গার্মেন্ট সেক্টরে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের জুট সেক্টরে বেসরকারি খাতে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি, কোনো এক্সপোর্ট অর্ডারও বাতিল হয়নি। করোনার মধ্যেও আমাদের পণ্য এক্সপোর্ট হয়েছে। বর্তমান বছরের চার মাসে গত বছরের তুলনায় আমরা ৪০ শতাংশ গ্রোথ বেশি পেয়েছি। সরকারি মিলের জন্য নানা জন নানান কথা বলছে যে আমরা শেষ করে ফেললাম, সেটা ঠিক না। বরং আমরা প্রাইভেট খাত থেকে অনেক বেশি উপকার পেয়েছি এবং লোকসান থেকেও মুক্ত হয়েছি। তাই এসব মায়াকান্না দিয়ে সরকারকে বিপথে পরিচালনা করার কোনো অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি। সরকার সঠিক জায়গায় হাত দিয়ে লোকসানি মিলগুলো বন্ধ করেছে এবং তাদের খুশি করে বিদায় দিয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতও এগিয়ে গেছে। পাট খাতও এগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে।

প্রশ্ন : শ্রমিকদের পাওনা কীভাবে এবং কবে নাগাদ পরিশোধ করতে পারবেন?

গোলাম দস্তগীর গাজী : আমরা শ্রমিকদের পাওনা বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করছি। মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৭৪৪ জন। ইতিমধ্যে আমরা ১৫টি মিলের টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। বাকি মিলগুলোর টাকাও চলতি মাসের মধ্যেই পরিশোধ করে দেওয়া হবে।  প্রধানমন্ত্রী যে কমিটমেন্ট করেছিলেন সেটা তিনি যথাযথভাবে রক্ষা করছেন।

শ্রমিকদের সমুদয় টাকা পরিশোধের পরপরই আমরা পিপিপিতে বা লিজে যাব। আমরা ১৫ থেকে ২০ বছরের জন্য লিজ দেব। এজন্য নীতিমালাও চূড়ান্ত করা হবে। যাতে কোনো সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করা না হয়।

প্রশ্ন : বহুমুখী পাটপণ্য নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনা কী?

গোলাম দস্তগীর গাজী : আমাদের ২৮২টি বহুমুখী পাটপণ্য আছে। প্রচলিত পাটপণ্য থেকে ডাইভারসিফিকেশন পাটপণ্যের ভ্যালু অনেক বেশি। গত বছর আমরা ১৪০০ কোটি টাকা বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রি করেছি। ইতিমধ্যে এই ২৮২টি পাটপণ্যের নাম উল্লেখ করে আমরা গেজেট করেছি। একই সঙ্গে এই পণ্য রপ্তানি করলেই ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আমরা এখন বহুমুখী পাটপণ্যের ওপর জোর দিচ্ছি। 

প্রশ্ন : প্রতি বছর পাট মৌসুমে বীজের সংকটের বিষয়টি সামনে আসে। এটি সমাধানে কোনো উদ্যোগ...

গোলাম দস্তগীর গাজী : পাট বীজ সমস্যা সমাধানে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। উচ্চফলনশীল জাতের (উফশী) পাট বীজের জন্য আমরা প্রকল্প নিয়েছি। আশা করি, আগামী তিন বছরের মধ্যে বীজের সংকট কেটে যাবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

গোলাম দস্তগীর গাজী : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর