মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পুলিশের বিরুদ্ধে যত অ্যাকশন

অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতি মাসে ১২০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

সাখাওয়াত কাওসার

২৮ জুন থেকে টানা কয়েক দিন রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড, রেললাইন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে তেজগাঁওকেন্দ্রিক মাদক কারবারিদের সেকেন্ড ইন কমান্ড শারমিন ওরফে স্বপ্নাসহ অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মাদক কারবারে পুলিশের-সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। ৪ জুলাই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ সভায় জানানো হয়, তেজগাঁও এবং  তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশের ১৫ থেকে ২০ জন অসাধু সদস্য মাদক কারবার জিইয়ে রাখতে মূল ভূমিকা পালন করছেন। নড়েচড়ে বসে ডিএমপি সদর দফতর। মাদক সেবন ও এর কারবারে জড়িত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করতে নেওয়া হয় বিশেষ উদ্যোগ। এর মধ্যে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য চাকরি হারাচ্ছেন। সিলেট নগরীর আখালিয়া নিহারীপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরদিন ১১ অক্টোবর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেনসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। পরদিন থেকে তিনি লাপাত্তা। গতকাল এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তের ডোনা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ তো গেল মাত্র দুটি অভিযোগ। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় বাড়ছেই। এসব অভিযোগের মধ্যে চাঁদা দাবি, ঘুষ, হয়রানি, মাদক ব্যবসা, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ আর্থিক অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগ  বেশি পাচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। তবে আশার খবর, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই পুলিশ সদর দফতর ত্বরিত অ্যাকশনে যাচ্ছে। গত চার বছরে বিভিন্ন অভিযোগে ৫৮ হাজার ১০১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ই-মেইল, মোবাইল ফোন বা সরাসরি এসব অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতি মাসে গড়ে ১২০০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, জমি দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ যেসব অভিযোগ আসছে এর প্রতিটি তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া চাকরিতে যোগদান করে অল্প সময়ের ব্যবধানে যারা অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পুুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ৫৮ হাজার ১০১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর, এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, হয়রানি, বিয়ের পর স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ না দেওয়া, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ভুক্তভোগীর মামলার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া, জমিজমা-সংক্রান্ত ইত্যাদি অভিযোগে তাদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়।

গত বছর রাজধানীর ওয়ারীতে সম্পত্তি দখলে ৮  থেকে ১০ কোটি টাকার আর্থিক সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার  মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানের বিরুদ্ধে। এই দুর্নীতিতে সহায়তার অভিযোগ ওঠে বংশাল থানার সাবেক ওসি সাহিদুর রহমান ও নবাবপুর ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ এসআই জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধেও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে কিছুটা বিব্রত অবস্থায় রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত পেশাদার এবং সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, জবাবদিহি এবং মনিটরিং নিশ্চিত করা হলে পুলিশ বাহিনীতে অপরাধ কমে আসবে। ডিএমপির বিষয়ে কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদকাসক্তদের শাস্তি  দেওয়ার আগে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছিল। যারা নিজেদের শোধরাননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডিএমপিতে মাদকাসক্ত কোনো সদস্য আমার কাছে এলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে পেলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতিতে অনড় ডিএমপি।’ পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ১৫ হাজার ৪৬৯ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ১৪ হাজার ৬৪১ জনকে লঘুদন্ড, ৭৫০ জনকে গুরুদন্ড, ৭৩ জনকে বরখাস্ত এবং পাঁচজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগের মধ্যে কেবল আইজিপি কমপ্লেইন সেলে ২০১৭ সালে ৬১৯টি, ২০১৮ সালে ১৩৭১টি, চলতি বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত ১৫০৩টি অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে লঘুদন্ড, গুরুদন্ড, চাকরিচ্যুতি, বাধ্যতামূলক অবসরসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বর্তমানে সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার হাতে ক্ষমতা আছে’ এ বিষয়টি ভুলতে না পারলে পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অপরাধ দমন করতে গিয়ে যাতে কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি না হয় সে বিষয়টি তদারকি করতে হবে পুুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। মানবাধিকারকর্মী এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের নজরদারি বা কমান্ডের দুর্বলতার কারণেই অপরাধ ঘটছে। আগেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত। তবে গত কয়েক বছরে টাকা-পয়সা  নেওয়া, জমির দখল, এমনকি ব্যক্তিগত বিরোধে পড়ার মাত্রা বেড়েছে। তবে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার কিছুদিন পরই দেখা যায় তারা স্বপদে বহাল। আঞ্চলিকতা বা রাজনৈতিক দোহাই দিয়ে অভিযুক্তদের শীর্ষ পর্যায় থেকে ছাড় পাওয়া উচিত নয়। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘কোনো অভিযোগ সত্য হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিভাগীয় শাস্তি ও ফৌজদারি বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্য হিসেবে কাউকে কোনো বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশেরই তদন্তের ভিত্তিতে আদালতের দেওয়া শাস্তির রায় সবাই দেখছি। বিচ্যুতির কারণে নিজ প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ যে ব্যবস্থা নেয়, তা বাংলাদেশে বিরল।’

আইনে যা রয়েছে : পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি-১৮৬১) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদন্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদন্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদন্ড দেওয়ার বিধান আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর