বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মানসিক চিকিৎসার নামে নিষ্ঠুরতা

জিন্নাতুন নূর

মানসিক চিকিৎসার নামে নিষ্ঠুরতা

হাসপাতালে পুলিশের এক কর্মকর্তাকে নির্যাতনের ভিডিও হয়েছে ভাইরাল

মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার নামে চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের নামে গড়ে উঠেছে নির্যাতন সেল। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী কেউই নেই। এমনকি নেই কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট। এর পাশাপাশি মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে একই ধরনের অনেক নির্যাতন কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযান হয় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। সর্বশেষ রাজধানীর আদাবরের একটি মানসিক হাসপাতালে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চিকিৎসার নামে মারধর করার পর এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক চিকিৎসা ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা কেন্দ্র নিয়ে আরও অনেক তদন্ত এবং অনুমতি দেওয়ার সময় সতর্কতা দরকার। এমনকি উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা পদ্ধতির আঙ্গিকে আমাদের দেশেও একই মানের না হোক কাছাকাছি পর্যায়ের চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার।

সূত্র জানান, মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে গড়ে ওঠা কেন্দ্রগুলো মানসম্মত নয়। এখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও সেবাকর্মী নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চিকিৎসা একটি স্পর্শকাতর বিষয় সুতরাং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল ছাড়া কারও পক্ষে এ চিকিৎসা দেওয়া অসম্ভব। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের চেয়ারপারসন ড. মাহফুজা খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কোনো রোগী নির্যাতনের শিকার হন- এটা ধারণার বাইরে। সমাজে এখন নতুন মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে আর তা হলো জীবন থেকে মানুষ এখন টাকা চায়, বিলাসিতা চায় কিন্তু এগুলো তারা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই চায়। মানুষ এখন পরিশ্রম ছাড়াই বেশি চায়। আর এজন্য ন্যায়-অন্যায় বোধ চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ অর্থের প্রতি অতিরিক্ত লোভের কারণে মানুষ এখন যে কোনো অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না। আবার বাংলাদেশের মতো দেশে সৎপথে কাজ করে অর্থ উপার্জন করার মতো ক্ষেত্রও নেই।

পরিশ্রম করে কোনো কিছু অর্জন করার যে মূল্যবোধ একসময় ছিল বা মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমল থেকে তা এখন আর নেই। অল্পতেই বেশি কিছু পাওয়ার যে প্রবণতা এখন তৈরি হয়েছে তা মানুষকে অন্যায়ের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে লাগাম টানতে এ ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরকারের শিগগিরই নজরদারি বাড়াতে হবে। নইলে এসব প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ বেঘোরে মারা যাবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মানসিক ও মাদকাসক্তি সংশ্লিষ্ট ভুঁইফোড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরিদর্শন, লাইন্সেস দেওয়া ও নবায়নের মতো মেকানিজম সরকারের আছে। এ প্রক্রিয়াগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন হলেই এসব প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। অর্থাৎ এ-সংশ্লিষ্ট সরকারি যে নীতিমালা আছে তা যদি ঠিকমতো কার্যকর করা যায় তাহলেই হবে। আমাদের দেশে প্রতিটি সেক্টরেই কিছু মানুষ আছে যারা যেভাবেই পারা যায় মুনাফা করতে চায়। এসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান যারা চালান তারাও একইভাবে মুনাফা করতে ইচ্ছুক। এসব হাসপাতালের মানের প্রশ্নে যদি আসি তাহলে বলতে হবে যে আমাদের এ-সংক্রান্ত নীতিমালার ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি আছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান যেখানে একই সঙ্গে মানসিক রোগী ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয় সেগুলো সাধারণত দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাধারণত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় আর মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র্র থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায়। কিন্তু দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি সমস্যাজনক। যারা এ ক্ষেত্রে সৎভাবে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক তাদের দুটি মন্ত্রণালয় থেকেই পৃথকভাবে লাইন্সেস করাসহ প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়; যা তাদের জন্য কিছুটা সমস্যা তৈরি করে। আবার মাদক নিয়ন্ত্রণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় কিন্তু মাদকাসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়। ফলে যখনই মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বিষয় আসবে তখন এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই থাকা উচিত। এজন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা দুটোই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। আশা করি, এতে সমস্যা কমে আসবে।’ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. মো. গোলাম রাব্বানী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আদাবরে নির্যাতনে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনাটি বেশ দুঃখজনক ও স্পর্শকাতর। তবে ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে তা আমাদের সঠিকভাবে জানতে হবে। ঘটনাটি ঘটার আগে কী ঘটেছিল তাও জানতে হবে। সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে তার পরিবারের লোকজন কেন এবং কীভাবে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তা-ও জানতে হবে। সাধারণত বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যেই খোলা হয়। আর বৈধ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের হাসপাতাল কীভাবে পরিচালিত হয় তা প্রশ্নই থেকে যায়। বিষয়টি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখা উচিত। এখানে নৈতিকতার বিষয়টিও আছে। কারণ যারা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলছেন তারা অর্থের লোভেই এ অপরাধ করছেন। আর এ অপরাধ রোধ করার দায়িত্ব সরকারের। আবার এসব প্রতিষ্ঠান খোলার আগে কিছু বাধ্যবাধতার বিষয় মানতে হয়। সেখানে প্রশিক্ষিত ও উচ্চ ডিগ্রিধারী সাইকিয়াট্রিস্ট ও কাউন্সিলর থাকতে হবে। আর এ বিষয়গুলো না মেনে যদি কেউ হাসপাতাল খুলে বসেন তবে তারা অপরাধ করছেন। এ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আবার যারা সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তারাই বা কেন সেখানে যাচ্ছেন তা-ও জানতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর