বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

দল ও এমপিদের মতামত ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর সব মেগা প্রকল্প মন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি!

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনামন্ত্রীর বাড়ি শান্তিগঞ্জে স্থাপিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এমন পরিবর্তন আনায় আশাহত সুনামগঞ্জবাসী। বিশ্ববিদ্যালয়টি জেলা সদরে স্থাপনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন সুনামগঞ্জবাসী। হাওরাঞ্চলের শিক্ষার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার এই বিশ্ববিদ্যালয়টি জেলা শহরের আশপাশে স্থাপনের দাবি জেলাবাসীর। এতে সব উপজেলার মানুষ লাভবান হবে। দলীয় ফোরামে আলোচনা না করে, জেলাবাসীর মতামত না নিয়ে কেবল ‘পরিকল্পনামন্ত্রীর ইচ্ছায়’ প্রধানমন্ত্রীর উপহার এই বিশ্ববিদ্যালয়টি শান্তিগঞ্জ এলাকায় স্থাপনের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। চলতি অধিবেশনে আইন আকারে পাসের জন্য যে কোনো দিন সংসদে উত্থাপন করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকায় স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান ও সিনিয়র সহসভাপতি নূরুল হুদা মুকুট।

এদিকে, জেলা সদরে স্থাপনের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন সদর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। তাঁর প্রস্তাবটি গৃহীত না হলে জনমতকে উপেক্ষা করে শান্তিগঞ্জেই স্থাপন হবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখানে প্রধানমন্ত্রীই শেষ ভরসা। প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিআরটিএ অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার, যুব মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মতো প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সব মেগা প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা শান্তিগঞ্জের দুই কিলোমিটার এলাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আওয়ামী লীগের আগামী দিনের ভোটের রাজনীতিতে পড়বে বলে মনে করেছেন দলের কর্মীরা। তাই তাঁরাও স্বতঃস্ফূর্ত মানববন্ধন আন্দোলন করছেন। জানা যায়, জেলা সদরকে বাদ দিয়ে এতগুলো মেগা প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা শান্তিগঞ্জে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জেলার ছয়জন সংসদ সদস্যের সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। পরিকল্পনামন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে সব প্রতিষ্ঠানই শান্তিগঞ্জে স্থাপন করা হচ্ছে। বলাবলি হচ্ছে পরিকল্পনামন্ত্রী নাকি তাঁর গ্রামের বাড়ি শান্তিগঞ্জকেই সুনামগঞ্জের জেলা সদর করতে চান। তাই সব প্রকল্প তার এলাকায়। মেডিকেল নামে জেলা সদরে হলেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তার বাড়ির দুই কিলোমিটারের মধ্যে। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণ নিয়ে রবিবার রাতে জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁর বাসায় বৈঠক ডাকেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংশোধন এনে জেলার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষিণ সুনামগঞ্জে শান্তিগঞ্জে স্থাপিত হবে- এমনটা চূড়ান্ত হওয়ায় বৈঠকে অংশ নেননি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আইন চূড়ান্ত হয়ে গেছে, ‘আমি আলোচনায় বসব কোন দুঃখে। আমার দল ক্ষমতায়, এমন কিছু করা হলে সারা জীবন আমাদের (জনগণের কাছে) জবাবদিহি করতে হবে। আমরা চিরকাল ক্ষমতায় থাকব না। বিনা প্রতিবাদ ও বিনা বাধায় এমন কিছু করতে দেব না, যা সারা জীবন মানুষের কাছে জবাব দেওয়া লাগে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সহ এতগুলো মেগা প্রকল্প একটি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হলে কেবল রাজনীতির ওপরে নয়, এর নেতিবাচক প্রভাব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপরও পড়বে। আমি একাত্তর দেখেছি। কোলাবরেটরদের পরিণতিও দেখেছি, দেখেছি মানুষ তাদের কীভাবে ঘৃণা করে। অন্যায় কাজে সহযোগিতা করে আমি সেটা হতে চাই না। বয়স হয়েছে। সারা জীবন পকেটের টাকা খরচ করে জনগণের রাজনীতি করেছি। বৃহত্তর জনগণের সুবিধা যেখানে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হোক।’ বৈঠকে উপস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট বলেন, ‘রবিবার রাতে পরিকল্পনামন্ত্রীর ফোন পেয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি তিনি-সহ সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন বসে আছেন। মন্ত্রী মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের বৈঠক ডেকে তাঁকে সহযোগিতা করার অনুরোধ করেন। জবাবে আমি বলি, আমি সদরের মানুষ, এ ব্যাপারে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। আপনি সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের যে সহযোগিতা মন্ত্রী মহোদয় চেয়েছেন, সেখানে তো কমিটি থাকলেও বাস্তবে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কার্যক্রম নেই। বিগত তিন বছরে তিনটি বৈঠকও করা হয়নি। আমার এখানে কী করার আছে। সেটা সভাপতি, সেক্রেটারি দেখবেন।’ এদিকে, একটি জেলায় এতগুলো মেগা প্রকল্প উপহার দেওয়ার পর সঙ্গত কারণেই জেলার মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কথা থাকলেও জেলা সদরকে বঞ্চিত করে পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকার দুই কিলোমিটার ব্যাপ্তির মধ্যে সব প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় জেলার মানুষ ব্যথিত, মর্মাহত। তাঁরা মনে করছেন, এতে শত বছরে গড়ে ওঠা হাওরের রাজধানীখ্যাত সুনামগঞ্জ জেলা সদর অদূর ভবিষ্যতে একটি জনবিচ্ছিন্ন পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হবে।

সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী আপনি শুধু শান্তিগঞ্জের মন্ত্রী নন, আপনি এই জেলার তথা সারা দেশের মন্ত্রী। এই সুনামগঞ্জ শহর আপনারও। শতাব্দী প্রচীন এই শহরটিকে বঞ্চিত করে আপনি এতগুলো প্রতিষ্ঠান আপনার এলাকায় নিয়ে গেলে শহরটি অন্ধকার শহরে পরিণত হবে। আপনি সুসম উন্নয়নের পথে আসুন, জেলাবাসী আপনাকে আজীবন স্মরণ রাখবে। ক্ষুব্ধ ও আশাহত সুনামগঞ্জবাসী ইতিমধ্যে হাওরবাসীর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ সুনামগঞ্জ জেলা সদরে স্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে স্মারকলিপি দিয়েছেন। ২৫ অক্টোবর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জেলা সদরে স্থাপনের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচিতে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ গণমানুষের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বক্তৃতা দেন। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও এই দাবির পক্ষে পথসভা, স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অবস্থান, মানববন্ধন, মতবিনিময় ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর