শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাস পোড়ানোর আড়ালে কারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাস পোড়ানোর আড়ালে কারা

রাজধানীতে বাসে আগুন দেওয়ার নেপথ্যে কারা? বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে কেনইবা মাত্র চার ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আগুনে পোড়ানো হলো যাত্রীবাহী বাস? জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মী নাকি অন্য কোনো ঘটনার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে ঘটেছে এমন নারকীয় ঘটনা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত সময় পার করছে পুলিশ-র‌্যাবসহ একাধিক সংস্থার সদস্যরা।

তিনটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিএনপির ব্যারিস্টার নিতাই রায় চৌধুরী এবং অন্য এক নারী নেত্রীর ফোনালাপটিও প্রকৃতপক্ষে তাদের কিনা তাও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্য কারণগুলোর মধ্যে সম্প্রতি বাসের রুট পরিবর্তনসহ ২২টি কোম্পানির অধীনে ঢাকা সিটির যাত্রীবাহী বাস চলাচলের সিদ্ধান্তের কারণে বিক্ষুব্ধ কোনো পক্ষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তাও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি পরস্পরকে দায়ী করছে। দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

বিএনপি তাদের ‘নীলনকশা অনুযায়ী’ ভোটের দিন রাজধানীতে ‘বাসে আগুন দিয়ে নাশকতা করেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাজধানীতে বাস পোড়ানোর ঘটনা সরকারি এজেন্টদের ‘নাশকতা’। বিএনপিকে মামলার জালে ফেলে ভোট চুরির আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতেই এ ধরনের অপতৎপরতা। এদিকে বাসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক, নির্বাহী কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন, শেখ রবিউল আলম, যুবদলের সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সিনিয়র সহসভাপতি মোরতাজুল কবীর বাদরু, ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুল রহমান খোকন, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের পাঁচ শতাধিক জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলোয় এ পর্যন্ত খন্দকার মাশুকুর রহমানসহ ৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাগুলো করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিও রয়েছেন। পুলিশ বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছে। ডিএমপি বলছে, রাজধানীজুড়ে নাশকতার ঘটনায় ভাড়াটে অপরাধীরা অংশ নেয়। তাদের উদ্দেশ ছিল, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চলছে নাশকতাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা। ১২ নভেম্বর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৯টি বাস পোড়ানোর ঘটনায় জড়িতদের ধরতে বেশির ভাগকে এরই মধ্যে শনাক্তের দাবি পুলিশের।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বেশ কয়েকটি জায়গায় হঠাৎ বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় একটি কল রেকর্ড পেয়েছি আমরা। সেটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যারা কথা বলেছেন তাদের পরিচয় জানতে কাজ করা হচ্ছে। তবে এই কল রেকর্ড মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হিসেবে কাজ করবে। কল রেকর্ড আর আগুনের ঘটনার সঙ্গে কথোপকথনের মিল রয়েছে। গতকাল দুপুরে সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যালয়ে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

জানা গেছে, পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়, মতিঝিল থানায় করা মামলায় আসামিদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী ইশরাক হোসেন রয়েছেন। মতিঝিলে দুটি, শাহবাগে দুটি, পল্টনে দুটি এবং বংশাল, ভাটারায় ও কলাবাগানে একটি করে মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ও গতকালের অভিযানে মতিঝিলে একজন, শাহবাগে ছয়জন, পল্টনে নয়জন, বংশালে দুজন ও কলাবাগানে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই পাঁচ থানায় আটটি মামলা করা হয়। এরপর রাতে অভিযান চালিয়ে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল আরও একটি মামলার পর গ্রেফতার হয় দুজন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সম্প্রতি ঢাকা মহানগরে রুট পরিবর্তনসহ ২২টি কোম্পানির অধীনে যাত্রীবাহী বাস চলাচলের সিদ্ধান্তে অনেকেই বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের অনেকেই বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি।

পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উত্তর পাশে কর অঞ্চল-১৫-এ  পার্কিং করা সরকারি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর বেলা ১টার দিকে মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে অগ্রণী ব্যাংকের স্টাফ বাসে, ১টা ২৫ মিনিটে রমনা হোটেলের সামনে চলতি গাড়ি ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনে, শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে দেড়টার দিকে দেওয়ান পরিবহনে, ২টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশ সচিবালয়ের উত্তর পাশে রজনীগন্ধা পরিবহন এবং বংশালের নয়াবাজার এলাকায় ২টা ২৫ মিনিটে দিশারী পরিবহনে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২টা ৪৫ মিনিটে পল্টনের পার্কলিং-এ জৈনপুরী পরিবহন, বিকাল ৩টায় মতিঝিলের পূবালী পেট্রোল পাম্প সংলগ্ন দোতলা বিআরটিসি বাসে এবং ভাটারার কোকাকোলা মোড়ে ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহনেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

ডিএমপির উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, সুপরিকল্পিতভাবে যেহেতু ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, সেহেতু তাদের দলীয় পরিচয় আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত যাচাই-বাছাই করছি। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীও আছে। বিশেষ করে কয়েকজন ককটেলসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী অনেক আসামি রয়েছেন যারা আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দুর্বৃত্তরা যাত্রীবেশে বাসগুলোতে আগুন লাগিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেছে। যেসব বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তাতে ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১২ জন যাত্রী ছিলেন। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও এজাহারনামীয় অন্য পলাতক অভিযুক্তদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে থানা পুলিশের একাধিক টিম।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর