রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

হয়রানি বন্ধে পরিবর্তন ভূমি ব্যবস্থাপনায়

দুর্নীতি নামবে শূন্যের কোটায়, বাড়বে কর আদায়ের পরিমাণ, আগামী জুলাই থেকে থাকছে না ম্যানুয়াল পদ্ধতি

নিজামুল হক বিপুল

হয়রানি বন্ধে পরিবর্তন ভূমি ব্যবস্থাপনায়

ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। যার মাধ্যমে জমি নিয়ে ভোগান্তি, হয়রানি, অনিয়ম, দুর্নীতি স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে। জমি বেচাকেনা, রেজিস্ট্রেশন, নামজারি, জমির খাজনা বা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ, খাস বা পরিত্যক্ত জমি-পুকুর ইজারা গ্রহণ, হাটবাজারের ভিটি ইজারা, ওয়ারিশান জমি হস্তান্তর, জমি বন্ধক কোনো কিছুতেই আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। ভূমি মালিক ঘরে বসেই কম্পিউটারের মাধ্যমে অতি সহজেই এসব কাজ নিষ্পন্ন করতে পারবেন কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সরকার সবকিছু সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসছে। ওয়ানস্টপ সেবা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে এ পদ্ধতির পাইলট প্রকল্প সফলতার সঙ্গে শেষ হওয়ায় সরকার এখন ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। আগামীকাল এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী পাটোয়ারি বলেছেন, আগামী জুনের মধ্যেই সারা দেশে ডিজিটালাইজেশনের সব কাজ শেষ হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে কোনো নাগরিককে আর ভোগান্তি পোহাতে হবে না। হয়রানির শিকার হতে হবে না। প্রত্যেক নাগরিক তার ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ থেকে শুরু করে ভূমি ব্যবস্থাপনার সব কাজ ঘরে বসেই নিশ্চিন্ত মনে করতে পারবেন। তিনি বলেন, এটি হবে মুজিববর্ষে সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা।

একটি পরিসংখ্যান দিয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, এই ভূমি কর পরিশোধ করতে গিয়ে একটা লোকের নষ্ট হয় কমপক্ষে আট কর্মঘণ্টা। এই কর্মঘণ্টা হিসাব করলে ৩ কোটি ৬০ লাখ লোকের ভূমি কর পরিশোধ করতে বছরে আর্থিক ক্ষতি হয় গড়ে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। ডিজিটালাইজেশনের কারণে এই অর্থের সাশ্রয় হবে। তিনি জানান, এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে কমে যাবে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা, বিরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ ও বিভিন্নমুখী জটিলতা। দুর্নীতি-অনিয়ম শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সরকার প্রায় তিন বছর আগে উদ্যোগ নেয়। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে দ্রুততার সঙ্গে সরকারের এ উদ্যোগ সামনের দিকে এগোতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে এটুআই-এর সহায়তায় ই-নামজারি, অনলাইনে খতিয়ান, উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, মৌজা ম্যাপ অনলাইনে প্রকাশ করা ছিল অন্যতম। ভূমি সেবার বাকি কার্যক্রমগুলোও পর্যায়ক্রমে এর আওতায় আসবে।

ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্র জানায়, ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি ১০টি মডিউলসমৃদ্ধ ভূমি তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (এলআইএমএস) নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। এই সফটওয়্যারের আওতায় অন্য মডিউলগুলো হচ্ছে- ভূমি নামজারি ব্যবস্থাপনা, ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা, ভূমি নামজারি পর্যালোচনা ব্যবস্থাপনা, ভূমি মিস কেস ব্যবস্থাপনা, বাজেট ব্যবস্থাপনা, খাজনা সনদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। সবকটি পদ্ধতিই প্রস্তুত করা হয়েছে। ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো স¦য়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে।

ভূমি নামজারি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় ইতিমধ্যে সারা দেশে (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) ৪৮৮টি উপজেলা ভূমি অফিসে শতভাগ ই-নামজারি চালু হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা ভূমি অফিসগুলোতে আর ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে নামজারি হচ্ছে না। ই-নামজারির পদ্ধতিতে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৯ লাখ ২৯ হাজার ৮২৯টি অনলাইন নামজারি আবেদন জমা হয়েছে। এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০টি অনলাইন নামজারি নিষ্পত্তি হয়েছে। এ কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারায় সরকার প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০ অর্জন করেছে।

সরকার প্রতিবছর সারা দেশে ৫১১টি উপজেলা ভূমি অফিসের অধীনে ৩ হাজার ৪৬২টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি কর আদায়যোগ্য হোল্ডিং থেকে প্রায় ৬০৬ কোটি টাকা ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে। এই সেবাগ্রহীতার সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ। এই সেবাগ্রহীতাদের স্বল্প সময়ে, স্বল্প ব্যয়ে ও কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই সেবা প্রদানের জন্য ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতিতে ভূমি কর আদায়ের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার তৈরি করে।

ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় সরকার প্রথম পর্যায়ে দেশের ৮টি জেলার ৯টি উপজেলার পৌরসভা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের পাইলট প্রকল্প শুরু করে। এগুলো হচ্ছে- গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতী ইউনিয়ন ভূমি অফিস, ঢাকার সাভার থানার বাগধনিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস, মানিকগঞ্জ সদরের পৌর ভূমি অফিস, চট্টগ্রামের আনোয়ারার খাসখামা ইউনিয়নের ভূমি অফিস, কিশোরগঞ্জ পৌর ভূমি অফিস, নারায়ণগঞ্জের সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিস, জামালপুর সদরের জামালপুর পৌর ভূমি অফিস ও চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের ফরিদগঞ্জ পৌর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস এবং মতলব দক্ষিণের মতলব পৌর ভূমি অফিস। এগুলোর কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাইলট প্রকল্প সফল হওয়ায় সরকার এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে সারা দেশে ৬১ জেলার ৪৮২টি উপজেলায় একটি করে মোট ৪৮২টি পৌর/ইউনিয়ন ভূমি অফিসের এক বা একাধিক মৌজায় এ কার্যক্রম শুরু করবে। প্রত্যেক মৌজায় দুই হাজার হোল্ডিংকে টার্গেট করে এ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে আগামীকাল (১৬ নভেম্বর) থেকে। ইতিমধ্যে এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে আগামী মাসে এ কার্যক্রম শুরু হবে সারা দেশের ৩ হাজার ৪৬১ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। আর মুজিববর্ষে এ কার্যক্রম সারা দেশে শুরু হবে শতভাগ শেষ করার লক্ষ্য সামনে রেখে।

ভূমি সংস্কার বোর্ড বলছে, ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতির কারণে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ে প্রচলিত পদ্ধতির যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে অর্থাৎ কর প্রদান সম্পর্কে নাগরিকদের অজ্ঞতা বা স্বচ্ছ ধারণা না থাকা, ভূমি মালিকের অনুপস্থিতির কারণে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে না পারা, করের অর্থের পরিমাণ যৎসামান্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের কর পরিশোধের অনাগ্রহ, সময়, খরচ ও যাতায়াত নিয়ে ভোগান্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব-এসবের অবসান হবে।

নতুন পদ্ধতিতে প্রত্যেক নাগরিক ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে যে কোনো সময় যে কোনো স্থান থেকে ভূমি কর সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারবেন ও কর পরিশোধ করতে পারবেন। অনলাইনে পেমেন্ট করা ও অনলাইনে দাখিলা পাওয়ার সুযোগ পাবেন, নাগরিকের ভূমি অফিসে যাতায়াতের সময় ও খরচ এবং ভোগান্তি কমবে। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সঠিক দাবি নির্ধারণ পূর্বক ভূমি উন্নয়ন কর আদায় ও ব্যবস্থাপনা সহজ হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

সর্বশেষ খবর