সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কেনাকাটার নামে কী হয় রেলে

করোনার সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে পুকুরচুরি, ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেনাকাটার নামে কী হয় রেলে

করোনা সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় রীতিমতো পুকুর চুরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গ্লাভস থেকে শুরু করে থার্মোমিটার, জীবাণুনাশক টানেল, সাবান, মাস্কসহ বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। প্রতিটি পণ্য কেনা হয়েছে গায়ের মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে। অনিয়মের এসব তথ্য উঠে এসেছে রেল মন্ত্রণালয় গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এই দুর্নীতির জন্য রেলওয়ের ২৯ কর্মকর্তাকে সরাসরি দায়ী করেছে। একই সঙ্গে কমিটি বলেছে, ভবিষ্যতে এই কর্মকর্তাদের যেন কোনো রকম কেনাকাটায় সম্পৃক্ত না করা হয়।

জানা গেছে, করোনাকালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রী কিনতে গিয়ে কোনো দরপত্র আহ্বান করেননি। বরং কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা তাদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে স্বল্প মূল্যের পণ্য বেশি মূল্যে ক্রয় করেন। মূলত কর্মকর্তারা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর রেলপথ মন্ত্রণালয় গত ২৫ আগস্ট যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি গত ৫ নভেম্বর তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে কমিটি উল্লেখ করেছে, তারা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে সুরক্ষা সামগ্রী কেনার প্রমাণ পেয়েছে। করোনা সংক্রমণের সবচেয়ে পিক টাইম অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গ্লাভস কিনেছে ৩২ টাকা দিয়ে। ওই সময়ে বাজারে গ্লাভসের মূল্য ছিল ৮ টাকা। একইভাবে ২৫০ মিলি জীবাণুনাশকের মোড়কে দাম ১৩০ টাকা লেখা থাকলেও সেটি কেনা হয়েছে ৩৮৪ টাকায়। ১০ টাকার মিনি সাবান কেনা হয়েছে ২৫ টাকায়। ১২০ টাকা কেজির গুঁড়া সাবান বা ডিটারজেন্ট কেনা হয়েছে ১৮৮ টাকায়। একেকটি সার্জিক্যাল মাস্ক কেনা হয়েছে ৪০ টাকা করে, চীনের তৈরি কেএন-৯৫ মাস্ক কেনা হয়েছে ৭২৭ টাকা করে। অথচ ওই সময়ে কেএন-৯৫ মাস্ক বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। ব্লিচিং পাউডার কেনা হয়েছে প্রতি কেজি ১৯৩ টাকা করে। অথচ বাজারে প্রতি কেজি ব্লিচিং পাউডার ওই সময়ে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। প্লাস্টিকের চশমা কেনা হয়েছে প্রতিটি ৩৯৭ টাকা করে। অথচ সেই চশমাই বাজারে ও ফুটপাথে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়।

পাঁচটি জীবাণুনাশক টানেল কেনা হয়েছে ৬২ লাখ টাকায়। যার প্রতিটির মূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে দুটি টানেল চুক্তির আগেই সরবরাহ করে মডার্ন প্রাইম কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। চীনের তৈরি একেকটি ইনফারেড থার্মোমিটার রেলওয়ে কিনেছে ১২ হাজার ৩৬০ টাকা করে। ট্রলি ও ফ্লুমিটারসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয়েছে ৪১ হাজার টাকায়।

জানা গেছে, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ৯টি বিভাগের চাহিদাপত্র অনুযায়ী প্রধান সরঞ্জাম দফতর ২১ থেকে ২৯ জুনের মধ্যে করোনার সুরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩৩টি কার্যাদেশ দেয়। এই ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জনৈক ইকবাল এরই রয়েছে বেশ কয়েকটি। মিম এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৮৯ লাখ টাকা মূল্যের ছয়টি কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কৌশল অবলম্বন করা হয়। যেহেতু ৩ থেকে ৫ নম্বর গ্রেডের কর্মকর্তাদের একটি দরপত্রের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে সে কারণে তারা কার্যাদেশগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেন। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ করোনাকালে একই পণ্য কেনার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন দাম পেয়েছে। অর্থাৎ রেলওয়ের এক দফতর যে মাস্ক কিনেছে ৫৮৬ টাকায়, সেই মাস্কই অন্য দফতর কিনেছে ৭২৭ টাকায়। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় সরঞ্জাম কর্তৃপক্ষের প্রধান রুহুল কাদের আজাদসহ ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কেনাকাটায় সম্পৃক্ত না করার সুপারিশ করেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর