সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কলকাতা প্রতিনিধি

কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই

চলে গেলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শেষ হলো তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় পথচলা। ৮৬ বছর বয়সে বিদায় নিলেন প্রবাদপ্রতিম এই অভিনেতা, নাট্যকার, বাচিকশিল্পী, কবি ও চিত্রকর। গতকাল ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হাসপাতালে টানা ৪১ দিন লড়াই করেছেন এই সব্যসাচী। বেলা ২টা নাগাদ হাসপাতাল থেকে তার নিথর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ কলকাতার গল্ফ গ্রিনের বাড়িতে। বেলা ৩টায় তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। সেখানে শ্রদ্ধা জানান অভিনয় জগতের কুশীলবরা। এরপর তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মরদেহ শায়িত রাখা হয় রবীন্দ্রসদনে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় পদযাত্রা করে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই গান শ্যালুটের মাধ্যমে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। হেঁটে শেষ যাত্রায় অংশ নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, বিমান বসু, রাজ চক্রবর্তী, দেব, কৌশিক সেন-সহ অসংখ্য গুণমুগ্ধ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তার আদিপুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। তার পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন। সৌমিত্রের পিতা কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী ছিলেন।

জানা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ অক্টোবর বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারও আগে তিনি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। কখনো উন্নতি কখনো অবনতি- এই দোলাচলেই চলছিল সৌমিত্রের জীবন। প্লাজমা থেরাপি, শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচারসহ নানাভাবে অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। উন্নতির দিকে যাচ্ছিলেন সৌমিত্র। ১৩ নভেম্বর থেকে তার শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটে। হৃদযন্ত্র আর কিডনির জটিলতা অনেকটা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ‘হার্ট রেট’। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শনিবার চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, অলৌকিক কিছু না ঘটলে সৌমিত্রের সুস্থ হয়ে ওঠা অসম্ভব। না, অলৌকিক কিছু ঘটেনি! গতকাল (রবিবার) দুপুরে ফেরেন না ফেরার দেশে ‘বেলাশেষে’ খ্যাত এই কিংবদন্তি। বেলা ১টা নাগাদ বেলভিউ পৌঁছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সৌমিত্র কন্যা পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। সে সময় পৌলমী বলেন, দিদি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। এত যত্ন করে, ভালোবেসে, সম্মানের সঙ্গে বাবাকে আগলে রেখেছিলেন সকলে। বাবা চিরকাল আমাদের মনে রয়ে যাবেন।’ মমতা বলেন, ‘আমরা চলচ্চিত্র জগতের এক মহান ব্যক্তিকে হারালাম। সৌমিত্র দার কভিড হলেও তিনি কভিডের কাছে হারেননি। কারণ পরে তার নেগেটিভ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অন্য নানারকম শারীরিক উপসর্গ থাকায় চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। সৌমিত্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসাতালে যান পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, অভিনেতা কৌশিক সেন, ঋদ্ধিমান সেন প্রমুখ। করোনা ও লকডাউন আবহের মধ্যেই শুটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নিজের বায়োপিক ‘অভিযান’-এর শুটিং করেছিলেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতার ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে ডকুমেন্টারি ফিল্মের জন্য শুটিং করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সে দিনই তিনি জানান তাঁর শরীর ভালো লাগছে না।

বাংলায় ট্যুইট করে মোদির শোকবার্তা : বাংলায় ট্যুইট করে শোকজ্ঞাপন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি লেখেন ‘শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ চলচ্চিত্র জগৎ, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক অপূরণীয় ক্ষতি। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকড়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযুষ গাঙ্গুলী, কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সারেন, উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক, বিজেপি সাংসদ ও অভিনেত্রী লকেট চ্যাটার্জি, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ শ্রত্রুঘ্ন সিনহা, সংগীতশিল্পী অনুপম রায়- প্রত্যেকেই ট্যুইট করে এই বরণীয় শিল্পীর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ উপদূতাবাসের শেষ শ্রদ্ধা : সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানায় কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাস। গতকাল বিকালে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে তাঁর মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান উপদূতাবাসের প্রথম সচিব (প্রেস) মো. মোফাকখারুল ইকবাল। এ সময় বাবার মরদেহের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সৌমিত্রের কন্যা পৌলমী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মো. ইকবাল।

দুই বাংলায় শোকের ছায়া : সৃজিত মুখার্জি কিংবদন্তি সৌমিত্রের সাদাকালো বিষণœ একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন ‘ভালো থেক’। অভিনেতা শ্বাশত চট্টোপাধ্যায় ফেসবুকে লেখেন, ‘ভালো থেকো জেঠু’। প্রাক্তন ছবির গায়িকা ইমান চক্রবর্তী লেখেন, ‘এই নক্ষত্রের পতন হয় না, এই নক্ষত্র সর্বত্রই উজ্জ্বল।’ উপমহাদেশের বিখ্যাত সরোদ বাদক ওস্তাদ আশীষ খাঁ ফেসবুকে সৌমিত্রের সঙ্গে ছবি দিয়ে পোস্ট করে লেখেন, ‘প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পাঁচ সপ্তাহের লড়াই শেষ।’ এদেশের অভিনেত্রী তানভীন সুইটি লেখেন, ‘বিদায় ফেলুদা! বিনম্র শ্রদ্ধা! সৌভাগ্য হয়েছিল এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার। অসাধারণ একজন মানুষ। মুগ্ধ হয়েছি তাঁর ব্যবহারে।’ অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ ফেসবুকে লেখেন, ‘বিদায় ফেলুদা... বিদায় অভিনেতা।’ আন্তর্জাতিক মডেল ও ফ্যাশন আইকন বিবি রাসেল লেখেন, ‘মেনে নিতে পারছি না...আর কত হারাবো... সৌমিত্র দা আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন অনন্তকাল।’ কলকাতার অভিনেত্রী সায়ন্তনী দত্ত লেখেন, ‘আপনি আমাদের মধ্যে সারা জীবন বেঁচে থাকবেন স্যার!’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘প্রয়াত হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একজন দিকপাল। শিল্পী। চিন্তক।’ দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান ফেসবুক হ্যান্ডেলে পোস্ট করে লেখেন, ‘পর্দায় তিনি যখন অভিনয়ের গরিমা ঝেড়ে ফেলে চরিত্রের আচরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ভারতবর্ষের শিল্পভুবনে সেটা শুধু বিস্ময়কর একটা ঘটনাই ছিল না, ছিল এক নতুন যুগের শুরু।’ শক্তিমান অভিনেতা তারিক আনাম খান লেখেন, ‘অপু আজ চলে গেল! অবধারিত ছিল এই যাওয়া। তবু মনে বড় আশা ছিল এই যুদ্ধে অপু জিতবে।’ ওপার বাংলার অভিনেতা পরমব্রত লেখেন, ‘অনেকে ওনাকে গুরু মানেন, শিক্ষক বলেন, আমার কাছেও অবশ্যই তাই।’ এদেশের নায়িকা বুবলি ফেসবুকে সৌমিত্রের একটি সাদাকালো ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘রেস্ট অব পিস লিজেন্ড!’

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৪টিতেই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তার সর্বপ্রথম কাজ ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ’র অপুর সংসার। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি এর আগে রেডিওর ঘোষক ছিলেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সব থেকে জনপ্রিয় ফেলুদা।

তার বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী চক্রবর্তী, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, সুমিত্রা মুখার্জি, ওয়াহিদা রহমান তনুজাসহ বিশিষ্ট অভিনেত্রীরা। বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সিনেমা ছাড়াও তিনি বহু নাটক, যাত্রা এবং টিভি ধারাবাহিক অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন। নাটক পরিচালনা করেছেন। তার মঞ্চনাটক দলের নাম ‘সংস্তব’। তিনি ‘এক্ষণ’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি তার দলের হয়ে বাংলাদেশে গঙ্গা যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিবেশন করেন ‘গঙ্গাছড়ি’। তিনি ২০০৪ সালে পদ্মভূষণ, ২০১২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পান। ২০১৭ সালে তাকে ফ্রান্স সরকার লিজিয়ন অব অনার দিয়েছেন। রুপালি পর্দায় প্রায় ৬০ বছরের ওপর অভিনয় করেছেন এই কিংবদন্তি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর